শিরোনাম
অজ্ঞদের বাতিঘর ‘সারপুকুর যুব ফোরাম’
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫০
অজ্ঞদের বাতিঘর ‘সারপুকুর যুব ফোরাম’
জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট থেকে
প্রিন্ট অ-অ+

অজ্ঞ বা অক্ষর জ্ঞানহীন লোক শুধু নিজের নয়, সমাজের উন্নয়নেরও বড় বাধা। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অজোপাড়া গাঁয়ের নিরক্ষর লোকদের অক্ষর জ্ঞান দিতে তাই কাজ করছে 'সারপুকুর যুব ফোরাম'। পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস গড়তে তুলতেও নানা আয়োজন রয়েছে সংগঠনটির।


লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টিপের বাজার এলাকার তরুণদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই যুব ফোরাম। সংগঠনটির স্বপ্নদ্রষ্টা জামাল হোসেন, লালমনিরহাট সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। স্থানীয় আনসার সদস্য আব্দুস সাত্তারের ছেলে সে।


সারপুকুর যুব ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা জামাল হোসেন জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের রয়েছে আরও অনেক কর্মসূচি। বঞ্চিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠিকে তাদের নাগরিক অধিকার পাইয়ে দিতেও কাজ করছে তরুণদের এই সংগঠন। বাল্যবিয়ে ও ইভটেজিং বন্ধেও সচেতনতামূলক মতবিনিময় সভাসহ বিভিন্ন উদ্যোগও রয়েছে এই তরুণদের। সমাজের নিগৃহীত হরিজন ও দলিত সম্প্রদায়ের সকল বয়সের সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে অক্ষর দান করে বই পাঠে অভ্যাস গড়ে তুলছে তারা। তাদের ছোট ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি ও উপবৃত্তির ব্যবস্থাও করেছে এই যুব ফোরাম। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওয়াত হরিজন সম্প্রদায়ের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাদের প্রাপ্য জমি ফিরিয়ে দিতেও দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে 'সারপুকুর যুব ফোরাম'।


জামাল যুবছায়া সংসদের লালমনিরহাট ২ আসনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যন্নয়নের দাবিগুলো যুবছায়া সংসদে উপস্থাপন করে সে।



জামাল হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকেই বই পড়া ও অন্যকে পড়ানোর ভীষণ আগ্রহ তার। সেই থেকে পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এরপর পাড়ার সমবয়সী ২০ জন বন্ধু মিলে স্কুল টিফিনের টাকা দিয়ে বই সংগ্রহ শুরু করেন। পরে এলাকাবাসীর সাহায্য নিয়ে সারপুকুর অনির্বান ফেডারেশনের জমি লিজ নিয়ে ২০১৪ সালে সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার গড়ে তোলেন।


৪৫টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করা পাঠাগারটির। এখন এতে বইয়ের সংখ্যা এক হাজার ২০০টি। নিয়মিত ৬০ ও সাধারণ পাঠক এক হাজারের উপরে। চেয়ার-টেবিল না থাকায় মাদুরে বসেই বই পড়েন সবাই। বিদ্যুৎ না থাকায় দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে তাদের পাঠাগার।



জামাল হোসেন আরো বলেন, পাঠাগার দিলেই হবে না। গ্রামের নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান দান করতে প্রতিটি পাড়ায় তাদের সদস্যরা গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে অক্ষর জ্ঞানদান করেন। গরিব ও দুস্থ পরিবারের ছেলে মেয়ে যারা টাকার অভাবে অতিরিক্ত ক্লাস করতে পারে না, তাদের জন্য নিজের বাড়িতে মাদুরে বসিয়ে প্রতিদিন সকালে অতিরিক্ত ক্লাস নেন। এমনকি সপ্তাহে তিন দিন পার্শ্ববর্তী মসজিদ ও মন্দিরের বারান্দায় স্কুলমুখি করতে ছোট শিশুদের বিশেষ ক্লাস নেন জামাল।



সমাজের হরিজন ও দলিত শ্রেণীর লোকেরা অক্ষর জ্ঞানহীন ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত। তাদের বাড়িতে গিয়ে বিকেলে পড়াশোনা করান জামাল। তাদের ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে হরিজনদের জন্য প্রাপ্য অধিকার আদায় করে দিতে জামালদের অবদান রয়েছে। এখন এ অঞ্চলের হরিজন ও দলিতরা জানে সমাজে তাদের কী কী অধিকার রয়েছে।



যুব ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা জামাল হোসেন বলেন, যদি সরকারিভাবে কোনো সাহায্য পাওয়া যেত তাহলে হয়তো নিরক্ষরদের জন্য এখানে ছোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেত।


'সারপুকুর যুব ফোরাম'র মাধ্যমে বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা করে ১৩৪ জন ছাত্রীকে পড়াশুনার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।



যুব ফোরামের প্রত্যেক সদস্য নিজেদের পড়ালেখা শেষে প্রতিবেশীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেন। সকল শ্রেণীপেশার মানুষের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে কেন্দ্রীয় একটি পাঠাগার ও ৪টি শাখা পাঠাগার রয়েছে যুব ফোরামের। সপ্তাহে একদিন বইগুলো এক পাঠাগার থেকে অন্য পাঠাগারে চক্রাকারে সকলের জন্য পৌঁছে দেওয়া হয়। বইয়ের অভাব পূরণে এই উদ্যোগ তাদের।


এত সব সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে জামাল হোসেন আঞ্চলিক থেকে জাতীয় পর্যয়ে ৭২টি ক্রেষ্ট ও সনদ অর্জন করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলায় একক অভিনয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, ২০১৫ সাল থেকে টানা চার বছর যুবছায় সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব পুরষ্কার, ২০১৭ সালের সেরাদের সেরা অ্যাওয়ার্ড, বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ বিএনসিসি, জেলা পর্যয়ে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক পুরষ্কার অন্যতম।



জামাল হোসেন বলেন, 'ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগালে সবকিছুই সম্ভব। হরিজন শ্রেণীর লোকদের বাড়িতে পড়াতে যাওয়ায় প্রথম দিকে গ্রামের লোকজন তাকে ঘৃণা করতো। তাদের বাড়িতে পানি খাওয়ায় তাকে কেউ খেতে দিত না। এখন গ্রামের লোকজন বুঝতে শিখেছে- হরিজনরাও মানুষ, তারাও এদেশের নাগরিক। তারাও সমাজের একটা অংশ। একাই নয়, পুরো মানব সমাজকে নিয়ে ভালো থাকার নামই সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।'


সারপুকুর হরিদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণি বলেন, অক্ষরজ্ঞানহীন অজ্ঞ ও অবহেলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জামালের আন্দোলন এই অজোপাড়া গাঁয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। সমাজ আলোকিত করতে যুব ফোরাম বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে।


বিবার্তা/জিন্না/কামরুল/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com