শিরোনাম
‘আমার হারানোতে দেশ স্বাধীনতা ভোগ করছে, এতেই আমি খুশি’
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৫০
‘আমার হারানোতে দেশ স্বাধীনতা ভোগ করছে, এতেই আমি খুশি’
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

‘আমি আমার জীবনের যা কিছু হারিয়েছি তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার হারানোর বিনিময়ে দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে, মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। এতেই আমি সুখী। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। দেশের মানুষ যদি সুখে থাকে তাহলে আমার কষ্টময় জীবন শান্তি পাবে।’


২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল বিবার্তা গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী এভাবেই তার মনের কথা প্রকাশ করেছিলেন।


ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শুরুতে রমা চৌধুরী আবেগে কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, আমি বাংলাদেশকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তাই আমি ১৬০ বছর বাঁচতে চাই। এই দীর্ঘকাল বেঁচে দেশটিকে সুখী-সমৃদ্ধশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই।


তার স্বপ্ন ছিল একটি অনাথ আশ্রম গড়ারও।


কিন্তু তার সেই আশা আর পূরণ হলো না। ‘একাত্তরের জননী’ খ্যাত রমা চৌধুরী আজ সোমবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


বিবার্তার পাঠকদের জন্য রমা চৌধুরীর কর্ম ও জীবন সম্পর্কে তুলে ধরা হলো-


এখনও বিবর্ণ বিক্ষিপ্ত দুপুরে, অবিরাম হেঁটে চলেন পায়ের তলায় তপ্ত মাটিকে উপেক্ষা করে। কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগ, মাথার ওপর চড়া সূর্যের আগুনে হাতছানি। তবুও বইয়ের বোঝা নিয়ে চলেন অবিরত।


আপনারা ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন, আমরা চট্টগ্রামের আলোকিত কন্যা রমা চৌধুরীর কথাই বলছি। হ্যাঁ, তিনি রমা চৌধুরী, একাত্তরের বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে নিজের ঘরবাড়ি, নিজের সৃষ্টি আর সর্বোপরি দু’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত এক জীবনসংগ্রামী।


নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে রমা চৌধুরীর গোছানো উপদেশ হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশটাকে আমাদেরই গড়তে হবে। দেশের মানুষকে আমি সেই কথাটিই বলতে চাই। চলুন, বিলাসিতা-উপভোগ এসব বাদ দিয়ে সবাই মিলে আমরা এই দেশ গড়ি।’


১৯৭১ সালের ১৩ মে ভোরে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে কোনো মতে আত্মরক্ষা করেছিলেন। এদিকে হানাদাররা গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। তিনি তার উপর নির্যাতনের ঘটনা ‘একাত্তরের জননী’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন।


২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানির বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বেচেই চলতো তাঁর জীবনজীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স করা রমা চৌধুরী পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায়।


মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেওয়া। এরপর গত ২০ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী। হ্যাঁ রমা চৌধুরী যেন এক শেষহীন সংগ্রামের নাম।




রমা চৌধুরীর যুদ্ধ থামেনি


রমা চৌধুরী। একাত্তরের বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপটায় ঘরবাড়ি, নিজের দু’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত এক জীবনসংগ্রামী। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। রমা চৌধুরী তাদেরই একজন।


রমা শুধু সম্ভ্রম হারাননি। এরপর থেকে তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন সামাজিক গঞ্জনা, অবহেলা আর অভাব-অনটন। সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের তালিকায় হয় তো তার দু’সন্তানের নাম যুক্ত হয়নি; কিন্তু রমা চৌধুরীর কাছে তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের বলি’। সব হারানো অদম্য এ নারী বুকে পাথর বেঁধে আজও জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও তাঁর যুদ্ধ এখনও চলছে।


রমা চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। ১৯৪১ সালে তাঁর জন্ম। বলা হয়ে থাকে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।


মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী। স্বামী ছিলেন ভারতে। ওইদিন পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় হানাদাররা তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে এক পাকিস্তানি সৈনিক।


হানাদারদের হাত থেকে কোনো মতে মুক্ত হয়ে প্রাণভয়ে রমা চৌধুরী পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। তার বর্ণনায় চারদিক থেকে দলে দলে হানাদাররা দেশীয় দালালদের সহযেগিতায় ঢুকতে থাকে তাদের বাড়িতে। হানাদাররা গান পাউডার ছিটিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।


চোখের সামনে ঘরের ভেতর রাখা মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম পুড়ে যেতে থাকলো। কিন্তু হানাদারদের ভয়ে কেউ সে আগুন নেভাতে এগিয়ে এলো না। এক পর্যায়ে রমা চৌধুরী ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসেন। চেষ্টা করেন ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিঁটেফোটা রক্ষা করার; কিন্তু ব্যর্থ হন।


পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর কেউ কেউ হয়ত সহযোগিতার হাত নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নিকটজনসহ সমাজের লোকদের কাছে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্ছনার পালা। হানাদারদের নির্যাতন ও ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। দরজা-জানালাবিহীন পুড়ে যাওয়া ঘরে শীতের রাতে থাকতে হয়েছে মাটিতে। লেপ-তোষক পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অনাহারে, অর্ধাহারে, ঠান্ডায় দু’সন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে গেল।


বিজয়ের আগের রাতে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। সন্তানকে সুস্থ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা রমা চৌধুরীর। গ্রাম্য চিকিৎসক দু-একজন অবশেষে আসলেন। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা গেল সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের অপর ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। মারা যায় টগরও।


মুক্তিযুদ্ধে নিজের সতীত্ব, দু’সন্তান হারানো। পরবর্তীতে সমাজের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অভাবের বিরুদ্ধে শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।


রমা চৌধুরীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা তিনি ‘একাত্তরের জননী’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখালেখি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানির বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা।


পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে সেই বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ’ প্রকাশ করেছেন।


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com