‘আমি ও আমার বিভাগ দুর্নীতিমুক্ত’ - এমন স্লোগান লেখা সাইনবোর্ড দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে। গেইটে রয়েছে একাধিক গার্ড। সব কড়াকড়ি মেনেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয় রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো অফিসে। ব্যুরোর পরিচালক আব্দুস সালাম এসব সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। কিন্তু বিবার্তার অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতার চিত্র, যার সঙ্গে এ সাইনবোর্ডের কোনো মিল নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালক আব্দুস সালামের গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি পর্যন্ত নেই। তিনি আজ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরে তার গ্র্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট জমাও দিতে পারেননি। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে আব্দুস সালাম ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালকের দায়িত্ব পান। এরপরই তার বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগপত্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেন ব্যুরোর সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলমগীর ফকির।
আলমগীর ফকির ওই অভিযোগে উল্লেখ করেছিলেন, আব্দুস সালাম স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালক হয়েছেন, কিন্তু তার কোনো মাস্টার্স অফ পাবলিক হেলথ বা এমপিএইচ সনদ নেই। এছাড়াও শিক্ষা ব্যুরোর বিধি অনুযায়ী হেলথ এডুকেটর পদে (ফিডার পদে) চাকরির বয়স ১০ বছর পূর্ণ হলেই কেউ জুনিয়র শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির উপযুক্ত হবেন। কিন্তু আব্দুস সালাম ফিডার পদে চাকরিই করেননি।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়েছিল, আব্দুস সালাম ছিলেন একজন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি নিয়োগবিধিবহির্ভূতভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে অনুপ্রবেশ করেন। এছাড়া সিনিয়রিটি লঙ্ঘন করে আব্দুস সালামকে পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযাগ করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ওই অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি। জানা যায়, আব্দুস সালাম মন্ত্রণালয়ে তদবির করে অভিযোগের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, অভিযোগকারী আলমগীর ফকিরসহ অভিযোগকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনেও যান তিনি। তাদেরকে ব্যুরো থেকে বদলি করার পাঁয়তারাও করা হয়।
মন্ত্রণালয়ে অভিযোগকারী আলমগীর ফকিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে অপারগতা জানান। শুধু আলমগীর ফকির নন, এ ব্যাপারে ব্যুরোর কর্মকর্তারা প্রথমে প্রতিবাদ বা সমালোচনা করলেও এখন সবাই চুপ হয়ে গেছেন। কারণ, তারা বুঝে গেছেন, প্রতিবাদ বা অভিযোগ করে লাভ নেই। এখানে তদবির করলে সবই সম্ভব। এখন শুধু আব্দুস সালামের মেয়াদ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন সিনিয়র কর্মকর্তারা। আর মেয়াদ শেষ হলেই সেই পদে দখল করার জন্য মরিয়া সবাই। এক্ষেত্রে সবার চাইতে এগিয়ে রয়েছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর উপ-প্রধান মো. বজলুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বজলুর রহমান ইতিমধ্যে আব্দুস সালামের সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছেন। এছাড়া পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে মন্ত্রণালয়ে তিনি নিয়মিত তদবিরও চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে বজলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না।
তবে গত সেপ্টেম্বর মাসে আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি উনার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তবে এটা উনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ওই অভিযোগের ব্যাপারে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুই হয়নি। তদবির করলে সেখানে সব করা সম্ভব হয় বলেও ইঙ্গিত দেন ওই কর্মকর্তা।
অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোতে অনেকেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নাম ভাঙ্গিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে খাচ্ছে। আর এই সংঘবদ্ধ চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর উপ-প্রধান (চলতি দায়িত্ব) মো. বজলুর রহমান। এমনকি তার বিরুদ্ধে সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী নিজেও লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বজলুর রহমান বলেন, কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বা লিখে, তাহলে আমার কিছুই করার নেই।
এদিকে আব্দুস সালামের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একাধিক দিন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো অফিসে গেলেও তার দেখা পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে একটি এসএমএস পাঠালেও কোনো ফিরতি এসএমএস আসেনি।
এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে আব্দুস সালামের বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করা হয়। কিন্তু সেখানেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু তার নাম ও পদবী এবং অফিসের ঠিকানা লেখা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সরকারী ওই ওয়েবসাইটে পরিচালকের জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিত উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন না থাকার কারণেই তিনি সরকারী ওয়েবসাইটে নিজের পরিচয় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব (শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ) ফয়েজ আহম্মদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোন কল রিসিভ করেননি।
বিবার্তা/খলিল/মৌসুমী/হুমায়ুন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]