রাজনীতি ও সংস্কৃতির আলয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৮
রাজনীতি ও সংস্কৃতির আলয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একই সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেও ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে এই ছাত্রাবাস। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক ইতিহাসের প্রমাণ্য দলিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।


বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর বিপরীত দিকে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে অবস্থিত সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (এসএম হল) একটি শতবর্ষী ঐতিহাসিক প্রাচীন ছাত্রাবাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের তিনটি ছাত্রাবাসের মধ্যে এটি অন্যতম।


১৯১২ সালের ২৭ মে ব্রিটিশ সরকার আবাসিক হল-ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ‘নাথান কমিটি’ গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলটি মূলত সচিবালয় হাউসের প্রথম তলায় ছিল। নিচতলার বৃহত্তম কক্ষটি ডাইনিং রুম, রান্নাঘর, সাধারণ ঘর, গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য কক্ষে বিভক্ত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে মুসলিম হলে মোট ১৭৮ জন আবাসিক এবং সংযুক্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৫ জন ছাত্রকে রেখেছিল। আবাসিক ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় মুসলিম হলের আলাদা ভবনের প্রয়োজন পরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলার তৎকালীন গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্যার ফ্রান্সিস স্ট্যানলি জ্যাকসন ঢাকার প্রয়াত নবাব বাহাদুর স্যার সলিমুল্লাহর নামানুসারে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৩১ সালের ১১ আগস্ট ভবনটি উদ্বোধন করা হয়।



বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হলটির নাম আংশিক সংক্ষিপ্ত করে ‘সলিমুল্লাহ হল’ বলে অভিহিত করা হলেও পরবর্তী সময়ে পূর্বের ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ নামটিই স্থায়ী রূপ পায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এর ডাক নাম রেখেছে এস এম হল।



ছাত্রাবাসটির ডাকনাম সম্পর্কে আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। অনেকে এই হলকে ‘জামাই হল’ নামেও ডাকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী মুসলিম ছাত্ররা এখানে থাকতেন বলে পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন পাত্র খুঁজতে এখানে আসতেন।


এস এম হল মুঘল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির এক সুসমন্বিত রূপ। বিশেষ করে নির্মাণশৈলীতে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির প্রভাব রয়েছে। চারদিকে উন্মুক্ত সবুজ চত্বর ঘেরা বৃহৎ প্রাসাদসম দোতলা ভবনটি দক্ষিণ দিক মুখ করা। এর চারটি শাখা, যার মাঝে একটি আয়তক্ষেত্র উঠোন রয়েছে- যা উত্তর ও দক্ষিণমুখী হাঁটার রাস্তা দিয়ে বিভক্ত। বারান্দাগুলি ভবনের সম্মুখভাগে উঠানের দিকে মুখ করা। দক্ষিণ শাখার কেন্দ্রে, প্রবেশদ্বারে তিনটি পয়েন্টযুক্ত খিলান- যার পার্শ্বে দুটি বর্গাকার টাওয়ার রয়েছে। প্রতিটির মাথায় একটি কন্দাকার হলুদ টাইল গম্বুজ করা। নান্দনিকতার ও গুরুত্বপূর্ণ হলুদ গম্বুজগুলো ভবনটির সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যুক্ত করেছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এর স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য, নির্মাণরীতি ও অলংকারশৈলী।


সামনে প্রশস্ত লন এবং বাগান পরিবেষ্টিত এ ভবনটির রূপ নজরকাড়া। শুধু স্থাপত্যশৈলীতেই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঐতিহ্যবাহী।


তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা। প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বইটিতে উঠে এসেছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবনে হলটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব।


সে সময়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হলটি। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা, সংগীতচর্চা, খেলাধুলা, বিতর্কচর্চা সবই হতো এসএম হলে। ১৯২৫ সালে হলের শিক্ষার্থীরা 'পতাকা' নামে একটি প্রকাশনা বের করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাড়াও পত্রিকাটিতে থাকত হলের সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন। হল থেকে প্রকাশিত হতো দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘মুসলিম হল ম্যাগাজিন’। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত মুসলিম হল ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথের ‘আহ্বান’ কবিতাটি ছাপা হয়।


মুসলিম হলের বর্ধিতাংশ বর্ধমান হাউজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডিবেটিং ক্লাব ‘আল মামুন ক্লাব’। ইসলামের ইতিহাসে ৭ম প্রগতিশীল আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের নামে এর নামকরণ। মুসলমান সমাজকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারায় পরিচালিত করতে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ স্লোগানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’।


আধুনিক নাট্য আন্দোলনের, মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক মুখপত্র 'শিখা' পত্রিকার সূচনা হয়েছিল এই হল থেকেই। বিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এস এম হলের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের সাথে জড়িত থাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বাংলার মানুষের কাছে বরাবরই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। জাতির পিতা এস এম হলের অনাবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি এই হলে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সংগ্রামের ইতিহাস, তাতে এই হলের অবদান রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান রচিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থের ৯৫, ৯৭, ১০৮ ও ১১২ পৃষ্ঠায় তিনি হলের স্মৃতিচারণা করেছেন। এই হল তাঁর জীবনে বিশেষ গুরুত্ব রেখেছে।


এস এম হল থেকেই শুরু হয়েছিল আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীক্ষা। দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকেই পরিচালিত হতো আন্দোলন। দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এস এম হলের ছাত্রদের নিয়ে হল চত্বরে সভা করেন। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৪৮ সালে মুসলিম হল ইউনিয়নের ভিপি (সহ-সভাপতি) ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফরকালে এ হলের ছাত্র সংসদের উদ্যোগেই বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল হলের বিশাল ডাইনিং টেবিলে। এ টেবিলে বসেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, লর্ড লিটন, স্যার আবদুর রহিম, ফজলুল হক, সুভাষ চন্দ্র বসুসহ উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। হল ইউনিয়নের আজীবন সদস্যপদ যাদের দেয়া হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কায়কোবাদ, স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন।


বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রসমাজের দূর্বার আন্দোলন বানচালের উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভাঙার পর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা সন্ধ্যায় এসএম হলে সমাবেত হয়।


ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করতে সেদিন হলের শিক্ষার্থী একরামুল আমিনের নেতৃত্বে একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। হলটিলে তাঁরা পরিণত করেন দুর্গে।


স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে এ হলের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এস এম হলের ১৮ জন শিক্ষার্থী ও কর্মী শহিদ হন।


বর্তমানে কাগজে-কলমে হলে বৈধ ৪৫ জন আবাসিক ও ৩৬৪ জন দ্বৈতাবাসিক ছাত্রসহ মোট ৪০৯ জন রয়েছে।


সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বর্তমান বয়স ৯২ বছর। হলের বারান্দার ফাটলজনিত কারণে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঝুঁকি বিবেচনায় নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকে সিট বরাদ্দ বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।


এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এলেও এই হলে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দেড়-দুই বছরের মধ্যে হলটি ছাত্রশূন্য করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।


বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ঐতিহাসিক সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভবনটি পর্যাপ্ত সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হবে। হল এলাকাকে সবুজ এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এ জন্য ধারণক্ষমতার বাইরের ছাত্রদের স্থানান্তর করে অস্থায়ী টিনের চালা ভেঙে দিতে হবে। তাই হলে ৪০৫ জন ছাত্র রাখা হবে বলেও মহাপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়।


সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর শিকদার বিবার্তাকে বলেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল একটি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী হল। মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রেই এই হলের অবদান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত এই হলের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর জ্যোষ্ঠপুত্র শেখ কামাল এই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি এই হলের ক্রীড়া দলের দলনেতা ছিলেন।


তিনি আরো বলেন, গত তিন বছরে কোনো শিক্ষার্থীকে এই হলে এলটমেন্ট দেওয়া হয়নি- ফলে এই জায়গা নির্জন গ্রামে পরিনত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এই হল সংস্কার করে ছাত্রদের এলটমেন্ট দেওয়া শুরু করে- তাহলে আমি আনন্দিত হব।


সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল রউফ মামুন বিবার্তাকে বলেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল একটি ঐতিহ্যবাহী হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য যেমন ঠিক তেমনই এই হলের ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধু এই হলে থেকেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সকল ক্ষেত্রে এই হলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমি এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে আছি- এটি আমার কাছে ভীষণ ভালো লাগার একটা অনুভূতি। তবে এই হল এখন ঝুকিপূর্ণ। এজন্য এখানে আগের মতো স্টুডেন্ট এলটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না। এটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনা রয়েছে।


বিবার্তা/ছাব্বির/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com