“একাত্তরে গণহত্যার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের সাথে আজ থেকে বিদ্যায়তনিক, গবেষণামূলক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াকেন্দ্রিক সকল প্রকার যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন করছে। এখন হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের কোন প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফরে যাবে না ও পাকিস্তানের সাথে কোন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম পরিচালিত হবে না।”
এই সিদ্ধান্তটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের। ২০১৫ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক একাত্তরের গণহত্যার দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিবাদ জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। এরপর থেকে দেশের সর্বোচ্চ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিন্ন রয়েছে। অথচ প্রায় ৮ বছর পরে এসে অমান্য করা হলো সেই সিদ্ধান্ত!
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মারূফ পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‘দাওয়াতে ইসলামীকে’ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) একটি সেমিনার আয়োজন করেছে। তিনি দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক। পাকিস্তানের সংগঠন কর্তৃক সেমিনার আয়োজনের এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, গত ৩ জানুয়ারি, মঙ্গলবার দুপুর ২টায় ঢাবি’র লেকচার থিয়েটার ভবনের আর. সি. মজুমদার মিলনায়তনে ওই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয়েছে, ‘দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ, ঢাবি'। সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘দাওয়াতে ইসলামী’র কর্ণধার পাকিস্তানি মাওলানা হাজী ইমরান আত্তারী। আর দাওয়াতে ইসলামী শিক্ষা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মারূফ সেমিনারে বক্তব্য রাখাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। এমনকি সেমিনারের জন্য মিলনায়তনও তার তত্ত্বাবধানে ভাড়া নেয়া হয়েছে।
ঢাবি সূত্রে জানা যায়, ‘দাওয়াতে ইসলামী’ একদিকে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সংগঠন অন্যদিকে পাকিস্তানের বক্তাও এসেছে অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাবির সেমিনারে। ফলে পুরো কার্যক্রমটি ২০১৫ সালের ঢাবির সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। কেননা, এই বছরের ১৪ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়।
পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার পটভূমি ছিল পাকিস্তান সরকার ২০১৫ সালে বলেছে- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কোন গণহত্যা হয়নি। বাংলাদেশে যদি কোন গণহত্যা না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি.সি দেবসহ অনেক শিক্ষকরা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন! তারা কিভাবে হারিয়ে গেলেন?
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তখন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তান যতক্ষণ পর্যন্ত না এই অন্যায়ের জন্য অর্থাৎ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গণহত্যা চালিয়েছে, বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে তার জন্য যতদিন ক্ষমা না চাইবে, ততদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দেশের সাথে কোনো একাডেমিক, কোলাবোরেশন, কালচারসহ ইত্যাদি কাজ করবে না।
সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঢাবিতে পাকিস্তানি সংগঠনের সেমিনার ও একই দেশের বক্তা উপস্থিত থাকার বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাবির সাবেক উপাচার্য ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এটা কোনভাবেই হতে পারে না। এই ধরণের কোন ঘটনা যদি ঘটে থাকে- পাকিস্তানি প্রতিনিধি দল এসেছে, সেখানে তারা বক্তৃতা দিয়েছে, এটা আমাদের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিভাবে এই ঘটনা ঘটলো? কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত? সেটার সম্পূর্ণ তদন্ত করে অতিদ্রুত অপরাধীধের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আমরা আমাদের শহিদদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।
আরও পড়ুন: ঢাবি শিক্ষকের যোগসাজশে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সংগঠনের সেমিনার!
একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন ) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বিবার্তাকে বলেন, ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর যে নৃশংস গণহত্যা চালায় তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা। সেদিন তারা আমাদের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৫শে মার্চের গভীর রাতেই অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, ২ লক্ষের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে। সেই পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠনকে এনে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণে সেমিনার করেছে, তা অবশ্যই ধৃষ্টতাপূর্ণ; তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় পাকিস্তানের সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি-ক্রীড়া সকল ক্ষেত্রে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া আছে। ফলে এই ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে বলে আমি মনে করি।
সার্বিক বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে বলেন, এই বিষয়ে আমাদের লিখিতভাবে জানাও।
বিবার্তা/জেএইচ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]