ঢাবি শিক্ষকের যোগসাজশে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সংগঠনের সেমিনার!
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৫২
ঢাবি শিক্ষকের যোগসাজশে ক্যাম্পাসে পাকিস্তানি সংগঠনের সেমিনার!
ঢাবি প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‘দাওয়াতে ইসলামী’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)-এ সেমিনার আয়োজন করেছে। দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মা'রূফের উদ্যোগে ওই সেমিনার আয়োজন করা হয়। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-‌শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।


জানা যায়, গত ৩ জানুয়ারি, মঙ্গলবার দুপুর ২টায় ঢাবি’র লেকচার থিয়েটার ভবনের আর. সি. মজুমদার মিলনায়তনে ওই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয়েছে, ‘দাওয়াতে ইসলামীর শিক্ষা বিভাগ, ঢাবি'। সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘দাওয়াতে ইসলামী’র কর্ণধার পাকিস্তানি মাওলানা হাজী ইমরান আত্তারী। আর দাওয়াতে ইসলামী শিক্ষা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মা'রূফও সেমিনারে বক্তব্য রাখাসহ সার্বিক ব‌্যবস্থাপনায় ছিলেন। এমনকি সেমিনারের জন্য মিলনায়তনও তার তত্ত্বাবধানে ভাড়া নেয়া হয়েছে। সেমিনারে ‘দাওয়াতে ইসলামী’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ সংগঠনের সাথে জড়িত ঢাবি শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন।




তথ্যসূত্র জানায়, ‌‍‍‘দাওয়াতে ইসলামী’ পাকিস্তানের এক‌টি ধর্মভিত্তিক সংগঠন। আবূ বিলাল মুহাম্মদ ইলইয়াস আত্তার ক্বাদিরী রযবী ১৯৮১ সালে দাওয়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানের করাচীতে এর সদর দফতর। আর এখানে রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ সড়ক ও জনপথ মোড়ে ফয়যানে মদীনার বাংলাদেশি মারকায তথা সদর দফতর অবস্থিত।



নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির একটি সূত্র বিবার্তাকে জানায়, ঢাবি দেশের প্রাচীন ও প্রধান প্রগতিশীল উচ্চ‌শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কাজেই ঢাকা বিশ্ব‌বিদ‌্যালয় ক‌্যাম্পাসে পাকিস্তানের ধর্মীয় সংগঠনের প্রোগ্রাম করা কোনো ভাবেই সমীচীন নয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই বিশ্ববিদ্যালয়েও ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা চালিয়েছিল। আবার তারাই ধর্মের দোহাই দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করবে, এটা ভাবাই যায় না।


সূত্রটি আরো জানায়, পাকিস্তানি ধর্মীয় মৌলবাদী নেতাদের এনে কিভাবে এই প্রোগ্রাম আয়োজিত হলো? তাদের আসল উদ্দেশ্য কী? আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কারা এর সাথে জড়িত? তাদের উদ্দেশ্য কী? ঢাকা বিশ্ব‌বিদ‌্যালয় প্রশা‌সনের এই বিষয়গুলো ভালোভাবে খোঁজ নেয়া উচিত।


তথ্যসূত্র জানায়, ২০১৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর প্ল্যাটফর্ম পরিবেশ পরিষদের ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত রয়েছে- যার সভাপ‌তি স্বয়ং বিশ্ব‌বিদ‌্যালয়ের উপাচার্য। পরে ডাকসু থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মভি‌ত্তিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়।


পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‍‘দাওয়াতে ইসলামী’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার আয়োজন করার বিষয় অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ডাকসুতে আমরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু এরপরেও পাকিস্তানের মতো একটি দেশের সংগঠন কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করে, সেটি বোধগম্য নয়। পাকিস্তানের সাথে আমাদের কী হয়েছে? সেটা কি আমরা ভুলে গেছি? বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি।



এদিকে গত বছরের ২ আগস্ট ঢাবি’তে অধ্যায়নরত হাফেজদের নিয়ে হাফেজ সম্মেলন এবং কুরআন পাঠ প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চেয়েছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি দাওয়াহ এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন। তারা ঢাবি'র শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মা'রূফের রেফারেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তন ভাড়া নিতে চেয়েছিল। তাদের প্রাথমিকভাবে অনুষ্ঠানের অনুমতি দিলেও পরে তা বাতিল করে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ। পরে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ঢাকা ইউনিভার্সিটি দাওয়াহ এসোসিয়েশনের আয়োজনে উক্ত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মা'রূফও।


পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‘দাওয়াতে ইসলামী’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করার বিষয়টি অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বিবার্তাকে বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরণের কার্যক্রম প্রত্যাশিত না। শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য আমরা শিক্ষা দান করব। নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ পরিপন্থী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো, মুক্তিযুদ্ধ এগুলোর সাথে যায় না; এই ধরণের কার্যক্রম যে শিক্ষকরা করেন, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিধির আওতায় আনা উচিত। আর এটিকে বিশেষ ব্যবস্থায়ও আনা উচিত।



তিনি বলেন, যতটুকু জানি- কলা অনুষদের ডিন এই প্রোগ্রাম করার অনুমতি দিয়েছেন। এখন তিনিই বলতে পারবেন এই ধরণের সেমিনার করার অনুমতি কেন দিয়েছেন? কী জন্য দিয়েছেন? কী উদ্দেশ্যে দিয়েছেন?



‘দাওয়াতে ইসলামী’কে অনুষ্ঠান করার অনুমতির দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির বিবার্তাকে বলেন, এটা আমিও জানতাম না। আর সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনো কখনো প্রোগ্রাম করে থাকেন। আরবি বিভাগের একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে এই সেমিনারটি হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।



তিনি বলেন, পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে জানতে পেরেছি যে- বিষয়টি নিয়ে একটু সমস্যা রয়েছে। তখন আমি তৎপর হয়েছি এবং উচ্চবাচ্য করেছি। প্রক্টরও বিষয়টি সম্পর্কে জানেন। পরে আমি মারূফ সাহেবকে বলেছি- আমাদের দেশ বিরোধী, বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী বা সমাজ-সংস্কৃতি বিরোধী কোনো কথাবার্তা হলে কিন্তু আপনাকে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। পরে উনি আমাকে কোনো সমস্যা হবে না বলে নিশ্চিত করেন।


পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সংগঠন ‘দাওয়াতে ইসলাম’-এর সেমিনারে অংশগ্রহণ ও সার্বিক সহযোগিতা করার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল-মা'রূফ বিবার্তাকে বলেন, সেমিনারে ওপেনলি সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমি এদের (দাওয়াতে ইসলামী) সম্পর্কে যেটুকু জানি ভালো আর-কি।


উল্লেখ্য, একাত্তরের গণহত‌্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসয‌জ্ঞের জন‌্য দায়ী দেশ পা‌কিস্তানের ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের এই ধৃষ্টতা সহ‌্য করা হবে না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিবার্তাকে জা‌নিয়েছেন।


বিবার্তা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com