বাংলাদেশ স্বাধীন ভূখণ্ডের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। গণতান্ত্রিক থেকে সামরিক, সামরিক থেকে আবার গণতান্ত্রিক সরকার এভাবে ইতিহাসের ঘাত প্রতিঘাতে এদেশের অগ্রগতি সাফল্যজনক ও উর্ধ্বমুখী। সমসাময়িক স্বাধীনতা অর্জনকারী বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রশংসনীয় এবং সম্প্রতি সময়ে এই অর্জন ঈর্ষনীয়। বড়ো বড়ো মেগা প্রকল্প দৃশ্যমান এবং অনেক প্রকল্প ইতোমধ্যে চালু হওয়াতে জনসাধারণ সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেছে।
স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের উত্থান বেশ প্রবীণ না হলেও জাতি হিসেবে বাঙালি বেশ প্রাচীন। স্বাধীন ভূখণ্ডের অধিকারী হয়ে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে যতটুকু মনোযোগ দিয়েছি তার কিয়দংশ রাষ্ট্র-সমাজ কাঠামো এবং ব্যক্তি মূল্যবোধ উন্নয়নে দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না। সেটা পারিনি বিধায় ছোটোখাটো ইস্যু নিয়েই আমরা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ি। এমনকি যে সকল বিষয়ের নূন্যতম গুরুত্ব বা ফিডব্যাক নেই সেগুলো নিয়ে অর্থ ও সময় অপচয় করে নেট দুনিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পক্ষে বিপক্ষে ঝড় তুলে নিজের অবস্থান জাহির করি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে এদেশের অবকাঠামো পুরাটাই ভেঙে পড়ে। সেই দিক থেকে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতা উত্তর এদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ছিল অনস্বীকার্য। তবে অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে সাথে রাষ্ট্র-সমাজ কাঠামো এবং ব্যক্তি মূল্যবোধের উন্নয়নের সমন্বয় সাধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি এখন প্রয়োজন রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি মূল্যবোধের উন্নয়ন। অবকাঠামোগত উন্নয়নকে ফলপ্রসূ করার জন্য হলেও আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ কাঠামো এবং ব্যক্তি মুল্যবোধ উন্নয়নে মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে বলে মনে করি।
সেটা না হলে বারবার পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলবে, রেলের নতুন কোচের সিটে ব্লেড মারবে, মেট্রোরেলের কোচের ভিতর বিজ্ঞাপনের স্টিকার সাটবে। উচ্চ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষিত চোর হবে, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যম অবৈধ অর্থ উপার্জন করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করবে। হুজুগে গুজবে দা, বটি, শাবল ইত্যাদি নিয়ে মধ্যরাতে রাস্তায় নামবে। রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে বুঁদবুঁদ ওঠা পঁচা ডোবার পানি বোতলবন্দি, অতঃপর গলাধঃকরণ করে গ্রামের পর গ্রাম পেটের পীড়ায় ভুগবে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের শিরোপা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে এক বন্ধু আরেক বন্ধুর বুকে ছুরি বসাবে। মাংসে লবণ কম হওয়াতে বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিলপূর্বক গ্রামসুদ্ধ লোক ট্যাটা যুদ্ধে লিপ্ত হবে!
প্রায়শই পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকবেন যে, বিভিন্ন হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার মেশিন-যন্ত্রপাতি দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, নষ্ট হচ্ছে। যদিও আধুনিক হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সেগুলো ব্যাবহার হোক বা না হোক কেনার মধ্যে একটা ভিন্ন ফজিলত থাকতে পারে। এর অর্থ এই যে, কেবল হাসপাতাল আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজালে চলবে না একইসাথে একদিকে এগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান গড়ে তুলতে হবে এবং সুবিধাভোগী রোগী/স্টেক হোল্ডার থাকতে হবে। তেমনি সকল অবকাঠামো উন্নয়নকে ফলপ্রসূ ও টেকসই করার জন্য দেশের জনগণকে এগুলোর যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণের মনমানসিকতার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে এবং এর জন্য ব্যক্তি মূল্যবোধের উন্নয়ন অপরিহার্য। যদিও সেটা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ তবে শুরুটা এখনি হওয়া দরকার।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় পরিবারের সবাই চেষ্টা করে শিশুদেরকে নীতি-নৈতিকতার বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়ার। চেষ্টা করে পাপ-পুণ্য, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝাতে; চেষ্টা করে সকল মানবিক গুণে গুণান্বিত করে গড়ে তুলতে। এত সকল চেষ্টার মাঝে, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক আমরাই আবার তাদের বিপরীত মেরুর দিকে প্ররোচিত করি। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বিয়ে-শাদী, দাওয়াত কিংবা মেজবান অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে অভিভাবকদের প্রায়শই বলতে শোনা যায় 'ভাত না খাইতে পারিস শুধু শুধু মাংস খা'। কেবল বাচ্চাদের প্ররোচিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সবজি, ডাল অন্য পদের পরিবর্তে নামমাত্র ভাতের সাথে মুরগীর লেগ পিস, নরম হাড্ডিসহ মাংসের বড়ো টুকরোগুলো পেটের অসম্মতিতে গলাধঃকরণ করে উদরপূর্তির প্রবণতা নেহাৎ কম নয়। যখন আমরা শিশুদের ভাত না খেয়ে বেশি বেশি মাংস খাওয়ার শিক্ষা দেই তখন তারা ভাত না খেয়ে বেশি বেশি মাংস খেয়েই বীরত্ব প্রকাশের আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে। এমন অনেক প্ররোচনা এবং নিজেদের প্রবণতা দুটোই শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ তৈরির পথে সাংঘর্ষিক ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয় যেগুলো খুব সহজে শিশুদের মনে দাগ কাটে সেগুলো আরো গভীরভাবে ভাববার এবং উদারভাবে বিবেচনার সময় এসেছে।
ভেবে দেখবেন কেবল ব্যক্তি মূল্যবোধের অভাবে বঙ্গদেশে মূর্খ ও অভাবী চোরের চেয়ে শিক্ষিত ও স্বভাব চোরের সংখ্যা ঢের বেশি এবং দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূর্খ ও অভাবী চোরকে সাধু বানানো সহজ হলেও শিক্ষিত ও সভাব চোরকে সাধু করা বেশ দুষ্কর। পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খোলা, ট্রেনের নতুন সিটে ব্লেড মারা, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করা মন-মানসিকতার লোকগুলো যে নিতান্তই মূর্খ সেটা বলা যাবে না। এগুলো তারা করে নিতান্তই হিংসার বশবর্তী হয়ে অথবা সহজাত প্রবৃত্তির দোষে। নিজের টাকার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হলেও এগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এগুলো জাতীয় সম্পদ, দেশের সম্পদ; মালিক আপনি, আমি, দেশের সকল জনগণ। সকল রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সম্পদের মালিক যে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সেই মূল্যবোধ এখনো ব্যক্তির মাঝে গড়ে ওঠেনি বিধায় বিপত্তি।
ব্যক্তি মূল্যবোধ ও রাষ্ট্র-সমাজ কাঠামো উন্নয়ন ব্যতীত এহেন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া অসম্ভব। এখনই এই পরিবর্তনের দিকে সামগ্রিকভাবে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার হতে পরে ব্যক্তি ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মূল ভিত্তি।
পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ এবং পিতা-মাতাই আদর্শ শিক্ষক। পিতা-মাতা এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা শিশুদের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরির প্রধান সহায়ক। শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারই প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি তার পরিবারেরই হয়ে থাকে। পারিবারিক শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যৎ মানসিক গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
পারিবারিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহানুভূতি, অনুপ্রেরণার মাধ্যমেই একজন শিশু সমাজে প্রত্যাশিত আচরণ করতে শেখে। আমাদের আচরণ, অভ্যাস, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি সবই পারিবারিক শিক্ষারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং এনজিও গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হলেই সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো মজবুত হবে। নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো মজবুত না করলে অবকাঠামো উন্নয়নের সুফল সুষমভাবে বণ্টন হবে না। কারণ নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো নাগরিক সমস্যার অনুপাতে সেবা প্রাপ্তির সংকট সৃষ্টি করে এবং এই সংকট অনৈতিক সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করে।
লেখক : মো. হাফিজুল ইসলাম হাফিজ, বি.এস.এস.(অনার্স), এম.এস.এস.(রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]