টিনের চাল, আর তলিয়ে যাওয়া ফিরোজা আপু
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪১
টিনের চাল, আর তলিয়ে যাওয়া ফিরোজা আপু
মোহাম্মদ সোলাইমান
প্রিন্ট অ-অ+

রাক্ষুসে রাত—২৯শে এপ্রিল! অনেকের কাছে এই রাতটা আসে বছরে একবার। কিন্তু আমার কাছে? আমার নির্ঘুম চোখে এই রাত বারবার ফিরে আসে রাক্ষসীর থাবার মতো। যেন এক ভয়াবহ ছবি, যা মুছে যায় না কিছুতেই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন। গাছে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাই। মনে আছে, মুখ ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম—
"ও মারে... ও আল্লাহ রে!"


আরও মনে পড়ে—এক মা তাঁর শিশুকে বুকে চেপে ধরে যখন পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলেন, সে দৃশ্য আজও চোখের কোনায় জমে থাকা কান্না হয়ে ফিরে আসে। শিশুটি হঠাৎ চিৎকার থামিয়ে দেয়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় পৃথিবী।


কিন্তু যেটা মনেই পড়ে না—আমার পায়ের নিচে দুই হাত দিয়ে যিনি আমাকে গাছে উঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেই ফিরোজা আপুকে কেন আমি গাছে উঠিয়ে তুললাম না? এই প্রশ্নটাই বুক চিরে কষ্ট দিয়ে যায় আজও। ভেসে থাকা টিনের চালে দাঁড়িয়ে আমার আপু—আমার জীবনের চেয়ে আপন। হাতে ধরে আমাকে গাছে ওঠালেন। আর নিজে? থেকে গেলেন নিচে, সেই রাক্ষুসে পানির মুখে।


ভেসে থাকা সেই চালের ওপর ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে এক তরুণ ইয়াসিন সুরা পড়ছিলেন। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলেন—"ইয়া আল্লাহ, আমাদের দুজনকে যদি নিয়ে যাও, তাহলে বাবা-মা কেউ বাঁচবে না। আমাকে নিয়ে যাও, কিন্তু আমার ভাইটাকে বাঁচাও।" কণ্ঠে ভর করছিল অশ্রু, গলায় কাঁপন, কিন্তু দোয়া থামছিল না।


সে রাতে আমি ছিলাম মহেশখালীর শরইতলা গ্রামের এক টিনের ঘরে, চাচার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে। রাতের আঁধারে ঘরে হঠাৎ কোমর সমান পানি ঢুকে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশ অন্ধকার, শুধু জল আর মানুষের আতঙ্কে ভরা চিৎকার। উপায় না পেয়ে আমরা দশ-বারো জন আশ্রয় নিই পাশের একটা টিনের চালায়।


পানির তোড়ে মাটির দেঁয়াল ধসে পড়ল। আমরা চালার ওপর উঠে ভেসে চলি অজানার দিকে। কিছুক্ষণ স্থির ছিলাম—তারপর একটা জোরালো ঢেউ এসে চালটাকে ভাসিয়ে নিয়ে একটা বাগানে এনে ফেলল। সেদিকে কীভাবে এলাম, বুঝতেই পারিনি।


যাদের বড় ভাই ছিল, তারা গাছে উঠতে পারছিল। কেউ কাউকে গাছে উঠিয়ে দিচ্ছিল। আমার ছিল না বড় ভাই—ছিল একটা বড় বোন, ফিরোজা আপু। ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।


তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন—"তুই গাছে উঠতে পারবি?" আমি বললাম—"পারব।" কিন্তু গাছে উঠতে গিয়ে পা পিছলে নিচে পড়ে গেলাম। তখনই আপু নিজে টিনের চালে দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে আমার পায়ের নিচে ঠেস দিলেন। আমি উঠে গেলাম গাছে।


কিন্তু...কেন যে আমি তখন আমার আপুকে উঠালাম না! কেন যে ওনাকে গাছে টেনে তুলিনি! এই "কেন"-এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই কেটে গেছে এতগুলো বছর। আর ২৯শে এপ্রিল এলেই কষ্ট বাজে অন্তরে।


–মোহাম্মদ সোলাইমান
ওসি সিএমপি পাঁচলাইশ


বিবার্তা/জাহেদ/এসএস


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com