এআই-চালিত ডিজিটাল মিডিয়া টেকনোলজিগুলো (ডিএমটি) সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে। এর দ্বারা সৃষ্ট অপতথ্যের প্রভাবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বে একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ডিএমটি’র নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
বিশ্বব্যাপী এই অপতথ্যকে অনেকে কুতথ্য, ভুয়া, ভুল ও জাল তথ্য বলে মিলিয়ে ফেলেন। যদিও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের একটি থেকে আরেকটি আলাদা। সাধারণ মানুষ সহজেই এদের পার্থক্য শনাক্ত করতে পারে না। তাই বাছ-বিচার না করেই তারা চলমান কন্টেন্টের ওপর খুব সহজেই আস্থা স্থাপন করে এবং পছন্দানুযায়ী আপন পরিমণ্ডলে সেটি শেয়ার করে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। বর্তমানে এর অনেক উদাহরণ আমরা বাস্তব সমাজে দেখতে পাই।
সন্দেহ নেই, আজকের বিশ্ব ডিজিটাল বিশ্ব। জীবনের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের ডিজিটাল সংযোগ, ডিজিটাল ক্রিয়েটিভিটি, ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স, ডিজিটাল ইকোনমি এবং ডিজিটাল সহায়তাকারী দরকার। এর ব্যবহার জীবনকে যেমন সহজ ও আরামপ্রদ করেছে, অন্যদিকে এর অন্তর্নিহিত ধূসর অঞ্চল আমাদের জীবনকে করছে ক্লেদাক্ত। ধূসর অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে অপতথ্যের উৎপাদন, ব্যবহার এবং এর অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া। ডিএমটি’র ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে আলাদা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ও কষ্টসাধ্য।
লেখাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কি ভাবে একজন সাধারণ মানুষ ডিএমটি’র এই ধূসর অঞ্চল চিহ্নিত কররে সক্ষম হবেন? কীভাবে অপতথ্যসমূহকে একটি কার্যকরী নিয়ন্ত্রক আইনের আওতায় আনবেন? কীভাবে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অ্যালগরিদম ও ডিজিটাল লিটারেসি ব্যবহার করে অপতথ্য, ভুয়া, জাল কিংবা কুতথ্যের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি হ্রাস করবেন?
শুরুতেই ডিসইনফরমেশন ও মিসইনফরমেশন এর মধ্যকার ছোট্ট একটি পার্থক্য জেনে নিই। ওয়ার্ডল ও দেরাকশান, ২০১৭ সালে তাঁদের এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, “ডিসইনফরমেশন ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়। এটি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি, উপস্থাপন এবং প্রচার করা হয়। এটিকে আমরা অপতথ্য বলি”।
অন্যদিকে, লেশার পাভেলেক এবং দেশাই, ২০২২ সালে বলেন, “সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেকটা ভুল করেই মিসইনফরমেশন উৎপাদন করা হয়। তথ্যের নির্ভুলতা কিংবা যথার্থতা যাচাই না করে অসচেতনভাবে তা উপস্থাপন ও শেয়ার করা হয়। এটি জনসাধারণকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয় না। মিসইনফরমেশন জনসাধারণের কাছে ভুলতথ্য বা মিথ্যাতথ্য বলে বিবেচিত”।
এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) আবিষ্কারের সাথে সাথে ডিজিটাল মিডিয়া প্রযুক্তি যেমন: সিন্থেটিক মিডিয়া, ডিপ-ফেইক, রানওয়ে এমএল, ডিপআর্ট, চ্যাটজিপিটি, এনএলপি, জিএএন, কম্পিউটার ভিশন ও লুমেন-৫ ইত্যাদি মানব জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে, এই ডিএমটিগুলো (DMTs) বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে বিশাল ইতিবাচক বিপ্লব এনেছে। অথচ এদেরও রয়েছে কিছু ধূসর অঞ্চল। জর্জ ক্রাসাদাকিস লিখেছেন "ডিজিটাল অপতথ্য সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য দিনের পর দিন এক বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
দেখা যায় যে, কোনো একটি পূর্ণাঙ্গ কন্টেন্টের অংশ বিশেষ (যতটুকু হলে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল হয়) কাট করে তার সাথে মিল রেখে নিজের মনগড়া একটি ন্যারেটিভ যুক্ত করা হচ্ছে। এর সাথে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য (অডিও ভিজ্যুয়াল ম্যাটেরিয়াল) সংযুক্ত করে সম্পূর্ণ অর্থ বদল করে যে কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে তা আবার সোশ্যাল মিডিয়ার নানান প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ইচ্ছানুযায়ী ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সমমনা দর্শক-শ্রোতারা এগুলো দেখে মুহূর্তেই তা গ্রাস করে নিচ্ছেন।” পুরো প্রক্রিয়াটি একটি ‘সাইবার অপরাধ’ যা ডিজিটাল মিডিয়া প্রযুক্তি (ডিএমটি) ব্যবহার করে অনবরত করে যাচ্ছেন অনেকেই।
জর্জ ক্রাসাদাকিস এই প্রসঙ্গটি টেনে বলেন, একসময় স্বীকৃত চ্যানেলের প্রচার মাধ্যমগুলো যেমন, রেডিও, টিভির সংবাদপত্রের তথ্য শতভাগ সঠিক ধরে নিতাম। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এসব মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্যে ভর করছে সন্দেহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিউ বাড়িয়ে যারা নিছক ভাইরাল হতে চান কিংবা নিজের ডিজিটাল প্রচারকে প্রসারিত করতে চান, সঠিক কৌশলে মিথ্যে তথ্য দিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে তারা খুব সহজেই যথাসময়ে এই কাজগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন করতে সক্ষম। এতে তার ভিউ বাড়ে। কারণ মিথ্যে তথ্যের বাণিজ্যিক মূল্যের কাছে সত্য তথ্যের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আর ঐ সকল কন্টেন্ট নির্মাতারা এগুলো ভাইরাল করে দিয়ে একরকমের সামন্তপ্রভুর ভাব নেন। আনন্দে আহ্লাদে ঢেকুর তোলেন। কারণ এখানে দর্শক-শ্রোতারা ফিলটার না করেই তার মতো করে সেটি গ্রহণ করেন, শেয়ার করেন এবং নিজের মনোজগতে সাময়িক প্রশান্তি অনুভব করেন। অথচ পুরোটাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৈরি। এভাবেই অপতথ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের অনলাইন বাস্তবতায় সুবিধাগুলো নিয়ে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। যা আগামী প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠছে।
ক্যাটরিনা কার্টিসোভা তাঁর 'নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার' প্রবন্ধে লিখেছেন, "মিথ্যা, ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে যে কন্টেন্ট তৈরি করা হয়, জনসাধারণের মাঝে তা চমকপ্রদ কায়দায় উপস্থাপন করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজে ভাইরাল হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু জনসাধারণের দারুণ ক্ষতি হচ্ছে।”
এই ক্ষতির পরিমাণ বিশ্বে চলমান যুদ্ধের ক্ষতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ যেমন সামাজিক সম্প্রীতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে; ঠিক তদ্রূপ, অপতথ্য বিশ্ব শান্তির জন্য সম্ভাব্য এক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। সুতরাং, এআই-চালিত ডিএমটিগুলো আধুনিক অ্যালগরিদম এবং নিয়ন্ত্রকের আওতায় এনে অপতথ্য উৎপাদন ও এর বিস্তার রোধ কল্পে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
ডিএমটি’র নেতিবাচক প্রভাবে অপতথ্য, ভুল, জাল কিংবা কু-তথ্য এত দ্রুত ডালপালা গজায় যা কল্পনাতীত। প্রচার মাধ্যম হিসেবে যখন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ও এক্স এর মত জনপ্রিয় প্লাটফর্ম পেয়ে যায় তখন এই অপতথ্যের গতি আরও দুর্বার হয়। যেমন ধরুন, ‘ফেসবুক ডিপ্রেশন’ এই শব্দটি ডিএমটি’তে নেতিবাচক অর্থে সন্নিবেশত করা হয়েছে। বুঝানো হয়েছে, যে সকল কিশোরী মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশী সময় ব্যয় করেন, তারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন। ডিএমটিতে ‘ফেসবুক ডিপ্রেশন’ শব্দটি ঠিক এই অর্থে গেঁথে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি সকল কিশোরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অথচ এর দ্বারা সকল কিশোরী মেয়েদের একরকম অসম্মান করা হয়েছে। এরূপ বিভ্রান্তি কিংবা অপতথ্য অহরহ নানান রকমের ডিএমটিগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে। যেমন, ডিপ-ফেক, ডিপ-আর্ট, চ্যাট-জিপিটি, এনএলপি এবং জিএএন ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে, ‘সাইবার বুলিং’ শব্দটি নিয়েও আরেকটি নেতিবাচকতা তৈরি করা হয়েছে। এটি নিছক টিন-এজদের সমস্যা নয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া কিংবা পাশ করা তরুণ তরুণীদেরও মাঝেও ‘সাইবার বুলিং’ এর সমস্যা রয়েছে। তারাও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সাইবার বুলিং-এ জড়িত থাকতে পারে। অথচ ডিএমটিতে শুধু মাত্র টিন-এজদের জন্য এ শব্দটি গেঁথে দেয়া হয়েছে। একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফর্মগুলো অপতথ্য ছড়িয়ে সমাজে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে যে নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন তিনি নিজেও ইন্টারনেট দ্বারা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ট্রল হচ্ছেন। এগুলো মানুষের মূল্যবোধে আঘাত করছে। দুর্বল করে দিচ্ছে আমাদের নৈতিকতা, ঐতিহ্য, ও সামাজিক কাঠামোকে। নষ্ট করছে সাংস্কৃতিক শিষ্টাচার।
সম্প্রতি এক গবেষণায় ছয়জন লেখক ‘কাউন্টারিং ফেইক নিউজ’ নামক প্রবন্ধে ‘অপতথ্যের সৃষ্টি, প্রভাব ও প্রসারের কারণ উদ্ঘাটন করে তাঁদের অন্তর্দৃষ্টিমূলক পর্যালোচনা তুলে ধরেন। সেখানে তারা মন্তব্য করেন, ‘কম খরচে দায়সারা গোছের কন্টেন্ট তৈরি করে বেশী সংখ্যক দর্শক-শ্রোতার কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দ্রুত প্রচার করার প্রবণতা ক্ষতিকারক। জনসাধারণের পালস না বুঝে স্রোতের বিপরীতে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে এমন সব বিতর্কিত কন্টেন্ট তৈরি করা হয় যার একটাই লক্ষ্য, ‘ভিউ বাড়ানো’। বিভিন্ন গোষ্ঠীকে প্ররোচিত করে তাদেরকে নামেমাত্র সংযুক্ত রেখে সামন্তপ্রভুর মত নিজের বয়ান দিয়ে কন্টেন্ট বানানো, প্রচার, পুনঃপ্রচার ও শেয়ার করায় স্বার্থবাদীদের সহায়তা প্রত্যাশা করেন এই গোষ্ঠী।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিজেই স্বয়ংক্রিয় পন্থায় এজেন্ট রূপ নিয়ে প্রচারকারীর পক্ষে অপতথ্য ছড়ায়। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। ঘটছে আস্থার সংকট। একই সংবাদ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করার ফলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে তথ্য প্রবাহের ব্যাপ্তি এত বড় যে, এর মধ্যে ঠিক কোন জায়গায় সঠিক তথ্যটি লুকায়িত আছে, তা খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। মলাটের শিরোনাম আরও বিভ্রান্তিকর, যা দেখে বুঝার উপায় নেই যে এর ভিতরে কি আছে! অনেকসময় ভিতরের ন্যারেটিভের সাথে মলাটের শিরোনামের বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়া না। ফলে বিভ্রান্ত হন দর্শক-শ্রোতা’।
একইভাবে, সমাজের একাংশের জন্য যে খবর প্রত্যাশিত, অন্য অংশের জন্য সেটি মোটেও প্রত্যাশিত নয়। প্রত্যাশিতের কাছে যেটি সঠিক তথ্য, অপ্রত্যাশিতের কাছে তা অপতথ্য বা ভুয়া তথ্য। উভয় পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা ও হৈচৈ। বাড়তে থাকে ‘ভিউ’। চলতে থাকে লাইক, শেয়ার আর কমেন্টসের আগ্রাসন। মুহূর্তেই প্রচার পেয়ে যায় তথ্যটি। তা অপতথ্য হোক কিংবা সঠিক তথ্যই হোক। বাজার গরম করাই প্রচারকারীর মূল উদ্দেশ্য। সেখানেই তারা সফল।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল
ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/মাসুম/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]