শুরু হলো স্বাধীনতার বিভীষিকাময় যাত্রা
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১২:২২
শুরু হলো স্বাধীনতার বিভীষিকাময় যাত্রা
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

ষাটের দশক পুরোটাই জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এ দেশের মানুষ। বাষট্টির নিউক্লিয়াস, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ একের পর এক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ স্বাধিকার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। যার নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।


তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার প্রতিটা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ঢাকার পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে।


৩ মার্চের পরিবর্তে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। এতদিনে বাঙালি জাতি বুঝে নিয়েছে বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির বাঁচার কোনো পথ নাই। অপেক্ষা শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশের। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) লক্ষাধিক জনতার সমুদ্রে ভাষণ দেন।


এ ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এ আলোচনা ছিল সময়ক্ষেপণ এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশল।


একদিকে আলোচনা চলতে থাকে, অপরদিকে পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্র আনা হয়। পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্য নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। একই সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের চলে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় ভুট্টোকেও সঙ্গে নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্বসভ্যতায় এক জঘন্যতম গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ সূচনা করে।


অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় বলা হয়, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। এদিন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ ইয়াহিয়া খানের গাড়ির কনভয় স্টাফ হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার নামতেই সেই বহর আবার ফেরত গিয়েছিল প্রেসিডেন্ট হাউসের দিকে। কিন্তু সেই বহরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ছিলেন না। গাড়িতে তার জায়গায় বসেছিলেন ব্রিগেডিয়ার রফিক। পাকিস্তানি শাসক ও সেনাকর্মকর্তারা ভেবেছিল যে, এভাবে শেখ মুজিব এবং অন্যদের ধোঁকা দেয়া সম্ভব হয়েছে।


কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া খানের গতিবিধির সবটুকুই জানতেন। আন্দোলনকারীদের প্রতি সেনাবাহিনীর আচরণ বিশেষত সৈয়দপুর, রংপুর ও চট্টগ্রামে জনতার প্রতি সেনাবাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ বঙ্গবন্ধুকে আরও সতর্ক করে তুলেছিল। সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন সিদ্দিক সালিক। পরবর্তীতে তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ শিরোনামে একটি বই লেখেন।


এ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মুজিবের গোয়েন্দারা গোটা খেলাটা বুঝে গিয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিরাপত্তা দলে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ আর চৌধুরী দেখে ফেলেছিলেন যে, একটা ডজ গাড়িতে ইয়াহিয়া খানের মালপত্র বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। কর্নেল চৌধুরী তা শেখ মুজিবকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছিলেন।


সন্ধ্যা সাতটার সময়ে ইয়াহিয়া খান যখন বিমানে ওঠার জন্য এয়ারফোর্স গেট দিয়ে ঢুকছেন, তখন নিজের দপ্তরে বসে গোটা দৃশ্যটা দেখছিলেন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ফোন করে খবরটা শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেন।’ সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে এক বিদেশি সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন যে, ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন, এই খবরটা আমি নিশ্চিত করতে পারি কি না!’


ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করায় মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনার কী পরিণাম নিয়ে ওইদিন দুপুরে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন নিজের দপ্তরে বসে ভাবছিলেন। হঠাৎই সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে ওঠে। লাইনের অপর প্রান্তে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।


টিক্কা খান সরাসরি বলেছিলেন, ‘খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।’ খাদিম এই নির্দেশের জন্যই অপেক্ষাই করছিলেন। নিজের কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গেই ওই আদেশ পালনের কথা জানিয়ে দেন তিনি।


সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘আমি দেখছিলাম ২৯ ক্যাভালরির রেঞ্জাররা রংপুর থেকে আনানো পুরোনো এম-২৪ ট্যাঙ্কগুলো অয়েলিং করছিল। ক্র্যাকডাউনের সময় ঠিক করা হয়েছিল ২৬ শে মার্চ রাত একটায়। আশা করা হচ্ছিল যে, ততক্ষণে ইয়াহিয়া খান করাচিতে পৌঁছে যাবেন।’ ২৫ তারিখ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময়ে ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার টিক্কা খানের কাছে অনুমোদন চেয়েছিলেন ক্র্যাকডাউনের সময়টা এগিয়ে আনতে। কারণ তার কাছে খবর আসছিল যে, বাঙালিরা ব্যাপক প্রতিরোধের জন্য তৈরি হচ্ছে। সেই প্রতিরোধ প্রস্তুতি হওয়ার আগেই যাতে আক্রমণ করা যায়, সে জন্য সময় এগিয়ে আনার কথা ভাবছিলেন তিনি। ‘সকলেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বহনকারী বিমান তখন সম্ভবত কলম্বো আর করাচির মাঝামাঝি হবে। জেনারেল টিক্কা খান আদেশ দিলেন, ববিকে বলো যতটা সম্ভব দেরি করতে।’


রাত সাড়ে এগারোটায় পুরো শহরের ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করে। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়।’ সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। সৈয়দ বদরুল আহসান নিজের বই ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের বড় মেয়ে হাসিনা জানিয়েছিলেন যে গুলির আওয়াজ শুরু হতেই মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন।’


রাত প্রায় একটার সময়ে কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পৌঁছে। গেটে পৌঁছেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক স্থানীয় পুলিশ কর্মী সেই গুলিতে মারা যান। দোতলায় বঙ্গবন্ধু স্ত্রী ও সন্তানদের একটা ঘরে বন্ধ করে বাইরে থেকে আটকিয়ে দেন এবং যতটা সম্ভব জোরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর’।


প্রখ্যাত সাংবাদিক বি জেড খুসরু তার বই ‘মিথস্ এন্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ বইয়ে লিখেছেন ‘গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান ঘরের ভেতরে ঢোকেন। নিচে কাউকে পাননি তিনি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেখ মুজিবকে কর্নেল আদেশ করেন তার সঙ্গে ওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।’


মি. খুসরু আরও লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ার সময়ে শেখ মুজিবের খেয়াল হয় যে তিনি পাইপটা ফেলে এসেছেন। কর্নেল আর শেখ মুজিব আবারও ভেতরে গিয়ে পাইপ নিয়ে গাড়িতে ফেরত আসেন। কিছুক্ষণ পর শেখ মুজিবের মনে হয় যে তার হয়তো কোনো ক্ষতি করা হবে না। কর্নেলকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আসার আগে আমাকে জানানো হলো না কেন? কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে।’


জেড এ খান ‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইতে লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’। ‘আমি জেনারেল টিক্কা খানের কাছে ওয়ারলেসে জানতে চেয়েছিলাম আপনি কি চান শেখ মুজিবকে আপনার সামনে হাজির করাই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমি ওঁর মুখ দেখতে চাই না।’


সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘ওই রাতে মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষ মানুষকে আমরা গ্রেপ্তার করে এনেছিলাম। পরে চাকরবাকরদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিন দিন পরে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেপ্তার করার সময়েই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন, যেকোনো উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে।’


ওই রাতেই এক পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন ওয়ারলেসে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল আর জগন্নাথ হল থেকে কড়া প্রতিরোধ আসছে। ‘এক সিনিয়র স্টাফ অফিসার আমার হাত থেকে ওয়ারলেস সেটটা কেড়ে নিয়ে জানিয়েছিলেন ওদের শেষ করতে তোমার আর কত সময় লাগবে? চার ঘণ্টা! .. যত্তসব.. তোমার কাছে কী অস্ত্র আছে? রকেট লঞ্চার. রিকয়েলস গান. মর্টার.. সব কিছু একসঙ্গে চালাও.. দু’ঘণ্টার মধ্যে পুরো এলাকা দখল করে রিপোর্ট কর।’ (সিদ্দিক সালিক) চারটার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পাকিস্তানি সেনারা দখল করে নেয়।


শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা । বাঙালিদের জন্য ছিল একটি ‘কালরাত’ অপারেশন সার্চলাইট । এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ। ওই রাতে অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক এ এন এম মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. ফজলুর রহমান খান, ড. এ মুকতাদির, শরাফাত আলী, এ আ কে খাদেম, অনুদ্ধেপায়ন ভট্টাচার্য, সা’দত আলী, এম এ সাদেক প্রমুখ।


এছাড়া ওই রাতে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হল, ফজলুল হক, ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) এবং এসএম হলের অনেক আবাসিক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। শুধু ঢাকা শহরে সেদিন কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন সারারাত গণহত্যার পর বাঙালি প্রবেশ করো এক বিভীষিকার অন্ধকারে। শুরু হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনার লড়াই।


লেখক: তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)


বিবার্তা/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com