শিরোনাম
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:১২
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সমস্যা সমাধানে তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন।

 

নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের সামনে বাংলায় দেয়া ভাষণে তিনি এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবগুলো হলো-

প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা।

 

দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা।

 

তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা।

 

চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।

 

পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

 

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার হৃদয় আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। কেননা আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি। কয়েক দিন আগেই আমি আমার দেশে আশ্রয় নেয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। যারা ‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে নিজ দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত। অথচ তারা হাজার বছরেরও বেশি সময় মিয়ানমারে বাস করে আসছেন। এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমার ছোট বোনকে নিয়ে ছয় বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এখানে ভাষণ দেয়ার সময় এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সব মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে। এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে।’

 

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে জাতিসংঘের অধিবেশনে আট লাখ শরণার্থীর আশ্রয়দাতা দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রে। মিয়ানমারের নির্যাতিত এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য তার প্রশংসাও ঝরছে বিশ্বনেতাদের কণ্ঠে।

 

সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার আগেই জাতিসংঘে বিভিন্ন বৈঠক ও সভায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে তার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই শরণার্থীদের মিয়ানমারকে ফেরত নিতেই হবে।

 

অবশ্য, রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে মিয়ানমার সরকার রাজি না হলেও শরণার্থীদের যাচাই সাপেক্ষে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অং সান সু চি। আন্তর্জাতিক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যাননি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর।

 

কয়েক যুগ ধরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসছে বাংলাদেশ, যারা নিজ দেশ মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার। গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে শুরু হয় সেনা অভিযান; এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা রোহিঙ্গাদের এই মানবিক সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সমালোচনা করছে মিয়ানমার সরকারের।

 

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে নিজ ভূখণ্ড হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত আট লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা সকলেই জানেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকাতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এতে আমরা ভীষণভাবে চিন্তিত। এসব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ও জাতিসংঘের মহাসচিবকেও ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।

 

পরে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার ঘটনা তুলে ধরে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনে বাংলাদেশের পদক্ষেপ জাতিসংঘে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের কোথাও যাতে কখনোই আর এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত না হয়, সেজন্য আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

 

সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি নিন্দা জানিয়ে একইসঙ্গে তিনি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে। সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস জঙ্গিবাদকে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে নিজের দেশে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা।

 

তিনি বলেন, আমরা ধর্মের নামে যেকোনো সহিংস জঙ্গিবাদের নিন্দা জানাই। সহিংস জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে আমরা পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করেছি। বৈশ্বিক সন্ত্রাস মোকাবেলায় তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী-

 

১. সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে

 

২. সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে

 

৩. শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ মীমাংসা করতে হবে

 

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য এবং শত্রুতা নিরসনের জন্যও সব দেশের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

 

‘অব্যাহত শান্তি’র জন্য অর্থায়ন বিষয়ে জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাহসী এবং উদ্ভাবনমূলক প্রস্তাব প্রত্যাশা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘জাতিসংঘ শান্তিবিনির্মাণ তহবিলে’ এক লাখ মার্কিন ডলার প্রতীকী অনুদান দেয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।

 

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমুন্নত রাখার উপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আরো নারী শান্তিরক্ষী মোতায়েনে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘সার্কেল অব লিডারশিপ’র প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ বিষয়ে গঠিত ‘ভিকটিম সাপোর্ট তহবিলে’ এক লাখ মার্কিন ডলার অনুদানের ঘোষণাও দেন শেখ হাসিনা।       

 

তিনি আরো বলেন, অর্থ পাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার জগত থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

 

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নের প্রত্যাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কার্যকর পদক্ষেপ তুলে ধরতে গিয়ে বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সাফল্যের কথা বলেন তিনি। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

 

বিবার্তা/আছিয়া/নিশি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com