শিরোনাম
ইকো-ট্যুরিজম সাড়া জাগায়নি বৃহত্তর চট্টগ্রামে
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩১
ইকো-ট্যুরিজম সাড়া জাগায়নি বৃহত্তর চট্টগ্রামে
চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রিন্ট অ-অ+

প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ইকো-ট্যুরিজম আর ধর্মীয় ট্যুরিজমের বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও তা কাজে লাগাতে পারছে না বৃহত্তর চট্টগ্রাম। অথচ পাহাড় নদী সমুদ্র ও সবুজ অরণ্য- প্রকৃতির এই অনন্য চার নিদর্শনের আধার প্রাচ্যের রানীখ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমন চতুষ্টয়ের সমাহার রয়েছে।


তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নিয়ে পর্যটন শিল্পের জন্য বিরাট সম্ভাবনাময় একটি এলাকা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনযাত্রা ও জীবিকার বৈচিত্র্যময় দিক রয়েছে। যাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে দারুণ ইকো-ট্যুরিজম। একইসাথে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আদি নিদর্শনগুলোকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় ট্যুরিজমও গড়ে তোলা সম্ভব।


কিন্তু এতসব সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কার্যকর অবকাঠামোর অভাবে বিকশিত হচ্ছে না চট্টগ্রামের ইকো-ট্যুরিজম খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি, পর্যটন আকর্ষণের বহুমাত্রিকতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা বিধান এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকেও এই খাতে বছরে বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।


চিটাগং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ভ্রমণ করছে। যার পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্য যেমন জড়িত তেমনি চিকিৎসা সেবা গ্রহণ কিংবা প্রকৃতি উপভোগ করাও অন্যতম। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কিংবা উপজাতিদের ব্যতিক্রমী জীবনধারা অনেকের কাছে আকর্ষণের আবহ তৈরি হতো। এসব নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ইকো-ট্যুরিজম শিল্প বিশেষ করে ধর্মীয় ট্যুরিজমের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সৃজনশীল পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না।


চেম্বার সভাপতি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছেও আমাদের দেশে বিনিয়োগের প্রাক্কালে ইকো-ট্যুরিজম বিষয়ে তাদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করি। তারাও চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিমোহিত। চট্টগ্রাম অঞ্চলের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্যদিকে কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে রয়েছে দেশের অন্যতম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। ইকো-ট্যুরিজমে এসব বিষয় আমাদের দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করবে।


তিনি বলেন, ভারত শ্রীলংকা কিংবা নেপাল-মালদ্বীপ এসব দেশের অর্থনীতির প্রধান উৎস পর্যটন ব্যবসা। তারা কৃত্রিমভাবে পর্যটনকেন্দ্র বানিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। অথচ আমাদের এখানে পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবই আছে। কিন্তু বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি না।


অন্যদিকে রিলিজিয়াস ট্যুরিজম (ধর্মীয় পর্যটন) চট্টগ্রামে পর্যটন সম্ভাবনার আরেক দিক উল্লেখ করে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যটন শিল্পের জন্য বিরাট সম্ভাবনাময় একটি এলাকা। যেখানে ধর্মীয় পর্যটন শিল্পে দারুণ সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। এশিয়ার বৃহত্তম লেক রয়েছে রাঙামাটিতে। অথচ মানুষ জানেই না। এসবের জন্য কোন ব্র্যান্ডিং নেই।


তিনি বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় থাইল্যান্ড, চীন এবং জাপান থেকে প্রচুর ধর্মীয় পর্যটক আনার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সীতাকুণ্ড পাহাড়, আদিনাথ মন্দির, চন্দ্রনাথ মন্দির, স্বর্ণমন্দির ও লামার বৌদ্ধ মন্দিরকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলংকার কাছে তুলে ধরা গেলেও প্রচুর পরিমাণে পর্যটক আসবে।



এদিকে পার্বত্য অঞ্চলে ইকো-ট্যুরিজমের পরিকল্পনা বিষয়ে ‘কেমন হতে পারতো পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন’ শিরোনামে এক নিবন্ধে দিলশানা পারুল নামের এক গণমাধ্যমকর্মী লিখেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল, সবচেয়ে কালারফুল এবং সবচেয়ে ভাইব্রেন্ট সংস্কৃতি হচ্ছে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর। কাজেই এই এলাকায় যদি আপনি ট্যুরিজমকে প্রমোট করতে চান তাহলে এই এলাকার প্রাণ, প্রকৃতি এবং আঞ্চলিক জনগোষ্ঠির সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে তবেই সেটা করতে হবে। সভ্য পৃথিবী প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যে ট্যুরিজম সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এখন কিন্তু আর সেই যুগ নেই যে পাহাড়ের মধ্যখানে গ্র্যান্ড সুলতানের মত একটি হোটেল করবেন, আর বিদেশিরা সব ভিড় করবেন সেখানে। যে পর্যটক পাহাড় দেখতে চাইবে সে পাহাড়ের প্রকৃতি দেখতে আসবে, পাহাড়ের সংস্কৃতির রঙ কেমন সেটা আস্বাদন করতে আসবে, পাহাড়ের বৈসাবি দেখতে আসবে, সে থামি কিনতে চাইবে, অদ্ভুত সব বেতের ঝুড়ি কিনতে চাইবে, পাহাড়িদের খাবার কেমন সেটা হবে তার জন্য অ্যাডভেঞ্চার। সেভাবেই আমাদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে।


সম্প্রতি চট্টগ্রাম চেম্বারের উদ্যোগে ‘রাউন্ড টেবিল অন ইকো-টুরিজম’ শীর্ষক এক সেমিনারে পর্যটন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ডা. অনুপম হোসাইন বলেছেন, বাংলাদেশে ইকো টুরিজমের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কক্সবাজারের ইকো-ব্যবস্থা আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। সেখানে এখনও হেলথ টুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া যেসব এলাকার প্রকৃত ও প্রতিবেশ এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে সেখানে ইকো টুরিজম করার সুযোগ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই সুযোগ যথেষ্ট রয়েছে।


তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারত ১৯৯০ সালে এ বিষয়ে ন্যাশনাল পলিসি গ্রহণ করেছে। ন্যাশনাল পার্কগুলি সরকার নিজেই সংরক্ষণ করে। একই সাথে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও ব্যাপক হারে প্রণোদনা দেয়। যে কারণে ভারত, নেপাল, ভুটান ইকো-টুরিজমে ব্যবসা সফল হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো ইকো-টুরিজম পলিসি গ্রহণ করতে পারিনি।


এদিকে ট্যুর অ্যাসোসিয়োশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ থেকে শুধু মালয়েশিয়াতেই এক লাখ ৩৫ হাজার পর্যটক গেছেন। অন্যদিকে থাইল্যান্ডে ৮৫ হাজার, ভারতে প্রতিবছর পাঁচ লাখ এবং সিঙ্গাপুরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার যাচ্ছেন। এছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কায় ভিসা লাগে না বলে সেখানেও যাচ্ছেন বিপুল পর্যটক। তারপরও দেশের ভেতরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের একটি বড় অংশই হচ্ছে তরুণ-তরুণী।


বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন শিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচলিত পর্যটনের পাশাপাশি সুনির্দ্দিষ্ট পর্যটকের (টার্গেট ভিজিটর) প্রতি মনোনিবেশ বাড়াতে হবে। এতে সম্ভাবনাময় এই শিল্পের প্রসার যেমন হবে তেমনি দেশের কর্মসংস্থানও বাড়বে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে। যা অন্য যে কোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি।


বাংলাদেশকে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এ শিল্পকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা জরুরি। সুতরাং বিদেশি পর্যটক ছাড়াও অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারলেও পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও প্রচুর লাভবান হবে বাংলাদেশ।


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com