ভয়ংকর হচ্ছে ডেঙ্গু, বেড়েই চলেছে মৃত্যু, দায় কার?
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:২৩
ভয়ংকর হচ্ছে ডেঙ্গু, বেড়েই চলেছে মৃত্যু, দায় কার?
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

দিন যতই যাচ্ছে ততই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছেই। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর খবরও আসছে প্রতিদিন। আক্রান্তদের তালিকায় রয়েছে শিশু-বয়োজ্যেষ্ঠরাসহ সব বয়সীরা।


অথচ ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বছরের শুরুতেই ছিল বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা। তারপরেও কেন এমন ভয়াবহ হারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে? নগরবাসীর অভিযোগ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনসহ দায়িত্বশীলদের গা-ছাড়া ভাবের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ প্রকোপ কমাতে সিটি কর্পোরেশনসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।


২ সেপ্টেম্বর, শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একদিনে (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২১ জনের মধ্যে ঢাকায় ১৭ জন আর ঢাকার বাইরে ৪ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে এ বছর সর্বমোট মৃত্যু হয়েছে ৬১৮ জনের। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে মৃত্যু হয়েছে ৪৫৬ জনের আর ঢাকার বাইরে মৃত্যু হয়েছে ১৬২ জনের।

রাজধানীবাসির অভিযোগ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনসহ দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী খালেদ হাসান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায়। কিন্তু ক্যাম্পাসসহ এর আশপাশে এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়লো না! মাঝে মাঝে মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হলেও সেটাও নিয়মিত না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এই অবস্থা হলে, তাহলে তো অন্য এলাকার কথা কি ভাবা যায়?


ঢাকা উত্তর সিটির অন্তর্ভুক্ত মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে খুব আতঙ্কে আছি। চারপাশে অনেকের আক্রান্ত ও মৃত্যুর কথা শুনতেছি। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার এই প্রকোপ বেশি। কয়েক মাস হয়ে গেলেও এখনো কমছে না! আর কমবেই বা কিভাবে? দুই সিটি কর্পোরেশন আসলেই করেই টা কী? তেমন কোন কার্যকরী উদ্যোগ নাই। শুধু ফেসবুকে প্রচারণা করা হচ্ছে। আর এই প্রচারণা দিয়ে আসলেই হবেই কী?


তিনি বলেন, ডেঙ্গু যার হয়েছে কিংবা যে পরিবারের হয়েছে, কেবল তারা এর কষ্টটা হাড়েহাড়ে বুঝে। কাজেই আর কোন লোকদেখানো কাজ নয়, এখনই আমাদের সত্যিকারের কাজগুলো করতে হবে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনকে অগ্রণী পালন করতে হবে।


ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুর মৌসুমের আগেও আমরা অনেক কাজ করেছি। আর ডেঙ্গুর প্রকটেও আমাদের হাতে নেওয়া সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে ৩ স্তর বিশিষ্ট মনিটরিং ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন রুটিন মাফিক সচেতনতা কার্যক্রম করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিচ্ছেন।


তিনি বলেন, আমাদের মেয়র মহোদয়ের পক্ষ থেকে নগরবাসীকে ফোন দিয়ে কিংবা মেসেজ করে ডেঙ্গুর বিষয় সচেতন করা হচ্ছে। আমাদের চেষ্টার কোন কমতি নেই। কিন্তু কতটুকু পেরেছি তা বলতে পারছি না!



আপনারা এতো উদ্যোগ নিলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না কেন, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখুন- এটা সত্যি যে, ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো কমছে না। তবে এক্ষেত্রে আমি বলবো আমরা যার যার জায়গা থেকে কাজ করলে অবশ্যই এই প্রকোপ কমে আসবে।



ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো আমাদের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা করে থাকেন। আপনি তার সাথে কথা বললে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন।


এই বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বিবার্তাকে বলেন, আমরা দক্ষিণ সিটিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের রেখে কমিটি করেছি। তারা সেখানে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেট বিতরণ, মশক নিধন কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোকে লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে সেখানে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ করা হয়েছে। মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনায় আমরা এখনো নানা ‍উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।


ডেঙ্গু প্রকোপ না কমার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন- দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কমেছে। এখন যেসব আক্রান্তের কথা শুনছেন, সেগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে ঢাকার বাহিরের।


২১ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আয়োজনে রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির পর্যালোচনা হয়। তাতে বলা হয়, মারা যাওয়া ৬২ শতাংশ রোগীর লক্ষণ ছিল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, ২৫ শতাংশ রোগীর লক্ষণ ছিল এক্সপেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে মৃত্যু হয় ১০ শতাংশ রোগীর। আর বাকি ৩ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে। অবশ্য এসব রোগী ডেঙ্গু জ্বরের পাশাপাশি অন্য রোগেও ভুগছিলেন।



বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে বাড়ির আনাচে-কানাচে পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বেশি হয়েছে। ফলে দীর্ঘায়িত হয়েছে ডেঙ্গু মৌসুম।সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ায় আক্রান্তদের শক সিন্ড্রোম অর্থাৎ হঠাৎ শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হেমোরেজিক ফিবার বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে বাড়ছে মৃত্যু।



ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পরামর্শ জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বিবার্তাকে বলেন, দিনকে দিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এটা খুবই আশঙ্কার বিষয়। তাছাড়া অনেক রোগীর পরীক্ষাও হচ্ছে না। ফলে আমরা তাদের তথ্যগুলো পাচ্ছি না। তাই আমি মনে করি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিটি কর্পোরেশন আর আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা ২/৩টা বাসায় গিয়ে পানি পেলাম আর তাদের জরিমানা করলাম। এভাবে এর সমাধান আসবে না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, কেন আমি জরিমানার মধ্যে যাবো? কেন আমি নিজের ঘরটা নিজে পরিষ্কার করতে পারি না?


তিনি বলেন, আমি সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ করবো, বাসায় বাসায় পানি পরিষ্কার না করে রাস্তা-ঘাটের ড্রেনের মধ্যে মশার ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমি কিন্তু আমার এলাকায় এখন পর্যন্ত মশার ওষুধ ছিটানোর শব্দ শুনতে পাইনি!আমি মনে করি ব্যাপকভাবে উদ্যোগ নিয়ে ওষুধ দিতে হবে। আর ওষুধের মধ্যে অবশ্যই উপকরণ থাকতে হবে, কোনভাবেই যেন লোক দেখানো না হয় অর্থাৎ সত্যিকারের ওষুধ যেন হয়। সর্বোপরি আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ডেঙ্গুর বিষয়ে আমাদের সামগ্রিকভাবে সর্তক হয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায়, এটা আরও কন্ট্রোলের বাহিরে চলে যাবে।


তিনি প্রশ্ন রেখে আরো বলেন, মশক নিধনে ওষুধের কার্যক্রম কি দেখছেন? হয়তো তেমন দেখছেন না! ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে মশাকে মারতে হবে। তার লাভাকে ধ্বংস করতে হবে। আর মারতে হলে তো মশার ওষুধ দিতে হবে। কিন্তু মশার ওষুধ যেন কোনো জায়গায় নেই! এখন যেটা করা হচ্ছে - সেটা হলো কোন এলাকায় যদি ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হয় তাকে ট্রেস করা হচ্ছে অর্থাৎ তার বাসার আশপাশে মশার ওষুধ দেয়া হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে তেমন কিছু করা হচ্ছে না। সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। ফলে এটা নিয়ন্ত্রণে তো আমাদের ব্যাপক একটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমি দুইটা জায়গায় গেলাম, দুইটা বিল্ডিংয়ের উপর পানি পেলাম। এরপর ২ লাখ টাকা জরিমানা করলাম। এটা দিয়ে তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে না। এটা তো লোক দেখানো সস্তা জনপ্রিয়তা ছাড়া আমার কাছে কিছু মনে হয় না।


তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, রাজধানীর দুই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে বেশি ভর্তি । আর এখানে মারাও যাচ্ছে বেশি। এই দুটি হাসপাতাল হলো-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা হাসপাতাল। এই দুটি হাসপাতালের প্রত্যেকটিতে ১০০ এর উপরে রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমার হাসপাতালে। যদিও আমাদের জনবল খুব বেশি নেই। আমার ডাক্তার ও নার্সের সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা ম্যানেজ করে চালিয়ে নিচ্ছি। সবাইকে এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সচেতন হওয়ার উদাত্ত জানাই।


ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বিবার্তাকে বলেন, ডেঙ্গুর পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। এটাকে এখনই কন্ট্রোলে নিয়ে আসার চেষ্টা করা উচিত। আর আক্রান্তকে গড়িমসি না করে সাথে সাথে হাসপাতাল ও ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনসহ সবাইকে নিজ দায়িত্বের প্রতি সচেতন হয়ে ডেঙ্গু প্রকোপ কমাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com