শিরোনাম
সাংবাদিকতায় নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে : শ্যামল দত্ত
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২১, ২১:০৬
সাংবাদিকতায় নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে : শ্যামল দত্ত
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

আপনি যদি কাল গিয়ে বলেন, একটা পত্রিকা বের করতে চাই, তাহলে পেতে পারেন। খোঁজ নিয়ে দেখাই হবে না যে, আপনার কী যোগ্যতা আছে। কে সাংবাদিক, কে মালিক, কে সম্পাদক এদের কি কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? উত্তর হবে নাই। যার জন্য এখন যে কেউ বলতে পারেন কালকে আমি সম্পাদক, মালিক বা সাংবাদিক।
কথাগুলো বলছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত। গণমাধ্যমের মতো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান পরিচলনার জন্য প্রত্যেকটা ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট পলিসি বা নীতিমালা তৈরি সময়ের দাবি বলেও মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।


সম্প্রতি রাজধানীর মালিবাগস্থ দৈনিক ভোরের কাগজের অফিসে বিবার্তা২৪.নেটের সাথে কথা বলেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। একান্ত আলাপে উঠে আসে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর অতীত ও বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব, এসব সমস্যা উত্তরণে করণীয় এবং সেইসাথে প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ বিষয় নিয়ে তার গঠনমূলক ভাবনা। দীর্ঘ আলাপের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবার্তার পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।


বিবার্তা: আপনি যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন আর এখনকার সাংবাদিকতায় কোনো পার্থক্য দেখছেন কি?


শ্যামল দত্ত : পার্থক্য তো অনেক। তখনকার গণমাধ্যম বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমরা যখন আশির দশকের শেষের দিকে সাংবাদিকতা শুরু করি ৩৫ বছর পর যদি মূল্যায়ন করি তাহলে বলবো যে, একেবারে ভিন্ন একটা বাস্তবতায় আমাদের এখন কাজ করতে হচ্ছে। এখন একটা নতুন বাস্তবতা এসেছে। সাংবাদিকতার ধরনের পার্থক্য, সাংবাদিকতার মালিকানার পার্থক্য, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য এবং সর্বোপরি টেকনোলজির পার্থক্য। প্রযুক্তির এতো বেশি প্রভাব হয়েছে যে গণমাধ্যমেরর অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। গণমাধ্যমের ধরন পাল্টেছে, গণমাধ্যমের স্বাদ পাল্টেছে এবং পাঠকের রুচিও পাল্টেছে। সেইসাথে গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জও পাল্টেছে। আগে গণমাধ্যমের এতো চ্যালেঞ্জ ছিল না। গণমাধ্যমের এতো প্রকৃতিও ছিল না। টেলিভিশন ছিল না, অনলাইন ছিল না। সব মিলিয়ে বর্তমানে সাংবাদিকতায় একটা নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে।


বিবার্তা : দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।


শ্যামল দত্ত : মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যে তো কয়েক ধরনের গণমাধ্যম আছে। আমরা যারা প্রিন্ট মিডিয়ায় (পত্রিকায়) কাজ করি তাদের জন্য এক ধরনের বাস্তবতা। সেটার একটা প্যাটার্নও আছে। অন্যদিকে ২০০০ সাল থেকে নতুন করে যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন বিশেষ করে সংবাদ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। মানুষের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য টেলিভিশন একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেলিভিশন মাধ্যমের যে গ্রহণযোগ্যতা, এক্সেসিবিলিটিগুলো আছে বা তাদের প্রবেশগম্যতা, সেটি একেবারে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এরপর নতুন করে যেটি এসেছে সেটি হলো অনলাইন। অনলাইন একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। এখন অনেক মানুষ অনলাইনেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দেখে নেয়। আর শেষে যেটা আসছে সেটা হলো সামাজিক গণমাধ্যম। এই সামাজিক গণমাধ্যম পুরো গণমাধ্যমকে একটা বাস্তবতার মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে টেকনোলজির একটা দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে মোবাইল টেকনোলজি। মোবাইল পেনেট্রেশন টেস্টে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। আপনি যদি দেখেন এদেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষ তার মধ্যে ১৪ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আছে। ১০ কোটি সেই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এক্সেস আছে। ৬-৭ কোটি লোক পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক ব্যবহার করে। ফলে এটা একটা পুরো পণমাধ্যমের প্যাটার্নটাকে নতুন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করে দিয়েছে।


বিবার্তা : মুদ্রণ গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?


শ্যামল দত্ত : যে খবর আমি লিখবো, সে খবর পড়ার জন্য পাঠকরা পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কেন, যদি তাৎক্ষণিক খবরটি পেয়ে যায়। এই চ্যালেঞ্জটা শুধু বাংলাদেশের একার না। চ্যালেঞ্জটা বিশ্বজুড়ে সকল গণমাধ্যম ফেস করছে। এই চ্যালেঞ্জটা ফেস করতে গিয়ে অনেক জায়গায় অনেক সঙ্কটও তৈরি হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় অনেক নতুন বাস্তবতাও তৈরি হয়েছে। সঙ্কট বলতে বলছি যে, মানুষ এখন আর বড় একটা পৃষ্ঠার কাগজ নিয়ে বসে লম্বা সময় ধরে খবর পড়ার জন্য বসে থাকছে না। তাদের কাছে খবর পড়ার এক্সেসিবিলিটি অন্যভাবে আসছে। যেমন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এবং অনলাইনের মাধ্যমে আসছে। আর টেলিভিশন তো যেকোনো খবরের ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট দিচ্ছে। বা যেকোনো ঘটনা যখন ঘটছে তাৎক্ষণিক সম্প্রচার করছে। ফলে দর্শক-পাঠক তাৎক্ষণিকভাবে খবরটা পড়তে ও জানতে পারছে। এই বাস্তবতার কারণে প্রিন্ট মিডিয়ায় আমরা যারা কাজ করি, সেখানে একটা নতুন ধরনের সংবাদ পরিবেশন বা সংবাদের বিশ্লেষণ, সংবাদের নেপথ্যের খবর যেগুলো আসলে মানুষ একটু সময় নিয়ে জানতে চায় সে দিকে আমাদেরকে পরিবর্তিত হতে হচ্ছে। আগের মতো হার্ড নিউজ না দিয়ে, হার্ড নিউজের পরিবর্তে বিশ্লেষণের দিকে যেতে হচ্ছে। মানুষ টেলিভিশনে বা অলাইনে ছোট করে খবরটা দেখছে। পরে খবরটার বিস্তারিত জানতে চায়। খবরটার নেপথ্যের ঘটনাটা জানতে চায়। ঘটনাটা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটল সব খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে ও জানতে চায়। তখন তারা পত্রিকার দ্বারস্থ হয়।


বিবার্তা : এই বাস্তবতাটা কি শুধু বাংলাদেশেই, না বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও?


শ্যামল দত্ত : আমি সম্প্রতি নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। সেখানে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার অফিসে ম্যানেজমেন্টের সাথে আলাপ হয়। তারা বলছিল, আসলে একই ধরনের সঙ্কট তারাও ভোগ করছে। তাদের এখন ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন বাড়ছে। কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে হার্ড কপি বিক্রি কমে যাচ্ছে। সুতরাং এই জায়গাতে বাংলাদেশের গণমাধ্যও সেই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে বাধ্য। যদিও এখনো সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ওইরকম বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি, কারণ এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে বেশ কিছু মানুষের পত্রিকা পড়ার প্রতি আগ্রহ আছে। তবে তরুণ সমাজের মধ্যে পত্রিকা পড়ার প্রতি আগ্রহ ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে। অবশ্য পশ্চিমা গণমাধ্যম ইতোমধ্যে এই ধাক্কাটা সামলাচ্ছে।


মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে এই কারণে যে, বাংলাদেশে এখনো সবগুলো কাগজ মিলে যে সার্কুলেশন সেটা বাংলাদেশের শিক্ষার হারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা বলছি দেশে ৬০-৭০% মানুষ শিক্ষিত, কিন্তু সবগুলো কাগজের সার্কুলেশন মাত্র ২০ লাখেরও কম। ফলে এখনো অনেক রুম রয়ে গেছে, অনেক স্কোপ রয়ে গেছে, অনেক ধরনের সম্ভাবনা রয়ে গেছে। এখন সেগুলোকে অনুসন্ধান করতে পারলে সে জায়গাটাতে পৌঁছানো যায়। যেমন ভারতের দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার মাসিক সার্কুলেশন প্রায় ৯০ লাখের মতো। মানে ৯ মিলিয়ন। আর আমাদের ১ মিলিয়ন পত্রিকারও সার্কুলেশন নাই। সবগুলো পত্রিকা মিলিয়ে হয়তো ২ মিলিয়ন হবে। সেটা ভারতে শুধু একটা কাগজের সার্কুলেশন। যদিও সেটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ। তবে আশার কথা এই যে, বাংলাদেশে এখনো যারা মধ্যবয়স্ক, বিশেষ করে যারা একটু সিনিয়র তারা এখনো কাগজের পত্রিকাটা পড়তে চায়।


বিবার্তা : প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?


শ্যামল দত্ত : আগেই বলেছি বাংলাদেশে এখনো এক শ্রেণির পাঠক কাগজের পত্রিকাটা পড়তে চায়। আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে এই বাস্তবতাটা আর থাকবে না। প্রিন্ট মিডিয়া খুবই একটা চ্যালেঞ্জিং টাইমের মুখে পড়বে। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেটা হচ্ছে পত্রিকার মলিকানার প্যাটার্ন। এটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেছে যে, একটা সময় ছিল যখন যারা ডেডিকেটেড জার্নালিজম চাইতেন, শুধু তারাই পত্রিকা বের করতেন। আপনি যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক আজাদ এই তিনটা পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। আর সরকারি খাতে দৈনিক বাংলা। সে সময়টায় রাজনীতি ও গণমাধ্যম পাশাপাশি হাত ধরে চলেছে। এখন এসে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যবসা এবং গণমাধ্যম একে অপরের পরিপূরক হয়ে যাচ্ছে। যেটি দেশের জন্য ভালো না। যেমন ধরুন, যদি কোনো কর্পোরেট হাউজ কিংবা বড় কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যম চালায়, তাহলে তারা তাদের স্বার্থটাই দেখবে। আবার যদি আমি একটু ভারতের উদাহরণ দেই, ১৮৩৮ সালের ৩ নভেম্বর ব্যানেট কোলেম্যান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড যখন দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকা বের করে তখন এই ব্যানেট কোলেম্যান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড কী, বা পত্রিকার মালিকানা কার, এটা নিয়ে পাঠকদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না।


আপনি বাংলাদেশের যেকোনো একটি পত্রিকার কাগজ উল্টালে বুঝতে পারবেন যে, এটার মালিক কে। প্রতিদিন মালিকের খবর, মালিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানান বিষয় পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। ফলে এখানে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলবে, জনগণের দুঃখ, দুর্দশা, কষ্ট-বেদনা, সাফল্য, অর্জন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবে সে জায়গাটি আর হয় না। বরং মালিকের লাঠিয়াল হিসেবে, মালিকের হাতিয়ার হিসেবে, মালিকের মুখপত্র হিসেবে, ব্যবহৃত হওয়ার একটা বাস্তবতা তৈরি হয়ে গেছে বাংলাদেশে। যেটি মূলধারার সাংবাদিকতার জন্য ভালো না। ভালো সাংবাদিকতার জন্য কখনোই এটা কাম্য হতে পারে না। যে কারণে দেখবেন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সাথে গণমাধ্যমের যে চরিত্র সেটার মিল নেই। এর জন্য মানুষ বিকল্প তথ্যসূত্র খুঁজে। যদিও সেটা তারা পায় না।


বিবার্তা : বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার একটা বড় প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?


শ্যামল দত্ত : পাঠকরা যা পড়তে চায় সেটা না পেলে তারা বিকল্প মাধ্যম খোঁজে। আর বিকল্প মাধ্যম হিসেবে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো। যেমন ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদি। তবে সোশ্যাল মিডিয়া কোনো বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম না। এখানে যে কেউ চাইলে যেকোনো বিষয় দিতে পারে। এখানে কোনো এডিটোরিয়াল জাজমেন্ট নাই, এডিটোরিয়াল কোনো ইনস্টিটিউশনের মধ্য দিয়ে আসে না। ফলে এর দায়দায়িত্ব কারো নেই। আপনি কোনো তথ্য দিলেন আবার কিছুক্ষণ পরে তা মুছে ফেললেন। এটা শেষ। কিন্তু একটা পত্রিকায় যদি কোনো খবর ছাপা হয় সেটার দায়দায়িত্বটা কিন্তু পত্রিকাকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিতে হয়, প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি সম্পাদককে নিতে হয়, পত্রিকার প্রকাশককে নিতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কিন্তু সেই দায়বদ্ধতা নাই। আর দায়দায়িত্ব নাই বলে এখানে যা খুশি তা দেয়া যায়। এখন খুশি তা দেয়া এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা, যেটা গণমাধ্যমের চরিত্র হওয়া উচিত নয়। এই দ্বন্দ্বটা এখন বাংলাদেশে সাংঘাতিক আকার ধারণ করেছে।


এখানে সেই দায়দায়িত্বের অর্থে সম্প্রতি অনেকগুলো প্লটাফর্মের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। এসব প্লটাফর্মে হরহামেশাই দেখা যায় মানুষকে হেয় করে, যে মানুষটি একেবারে বিষয়টির সাথে জড়িত না, এমন কি তিনি বিষয়টি জানেনও না, তাকে জড়িয়ে নানারকম খবর, ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। এটা ব্যক্তির যে স্বাধীনতা ও অধিকার, যেটি সংবিধানে সংরক্ষিত আছে, সেটি চরম একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমি মনে করি যে, এই সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের একার না, এটা পৃথিবীর অনেক দেশে রয়েছে। গত মার্কিন নির্বাচনের আগের নির্বাচনে যেটাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছিলেন। সেটার একটা অ্যানালাইসিস যদি দেখেন তাহলে দেখবেন যে, মার্কিন প্রশাসন থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, রাশিয়া ফেসবুক, টুইটার এগুলোকে মেনিপুলেট করে নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। তখন এই অভিযোগে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার মানেটা কী, তার মানে হচ্ছে আপনি সোশ্যাল মিডিয়াতে পেনিট্রেট করতে পারেন, আপনি এটার মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব প্রয়োগ করে এটাকে গুড়িয়ে দিতে পারেন। এই ধরনের জিনিসগুলো এখন হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় ধর্মীয় ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় ফসবুকে উসকানীমূলক পোস্ট, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট বা কোনো ছবি প্রকাশের ফলে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংহিসতামূলক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। এসব বিষয়গুলো গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো সবই হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার সীমাবদ্ধতা।


বিবার্তা : সোশ্যাল মিডিয়ার এসব সীমাবদ্ধতা উত্তরণের করণীয় কী বলে মনে করেন?


শ্যামল দত্ত : সোশ্যাল মিডিয়ার এই সীমাবদ্ধতাটাকে অতিক্রম করে আপনি যে একটি পরিশীলিত গণমাধ্যম দেবেন সেই সুযোগটাও কিন্তু এখন নাই। সেরকম টেকনোলজি এখনো বের হয়নি। ফলে মানুষকে প্রচলিত গণমাধ্যমের দিকেই থাকতে হচ্ছে। আমার ধারণা যে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যদি কোয়ালিটিটিভ জাজমেন্ট পাওয়ারটা বাড়ে তাহলে এসব বিষয়গুলো ধীরে ধীরে কমে আসবে। দেখুন, পশ্চিমা দেশগুলোতে কেন এসব বিষয়গুলোতে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না, কারণ তাদের একটা নিজস্ব জাজমেন্টাল পাওয়ার আছে। তারা বোঝে কোনটা সত্য, আর কোনটা মিথ্যা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডোনাল ট্রাম্পের ব্যাপক একটা প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তারা কিন্তু ট্রাম্প থেকে বেরিয়ে এসেছে। দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, কোনটা সঠিক আর কোনটা সঠিক না। তারা একটা উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের দিকে ফিরে আসতে পেরেছে। এটা কত দিন থাকবে, কি থাকবে না সেটা আলাদা বিষয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে সেই জায়গাটিতে পৌঁছাতে হবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


বিবার্তা: অপেশাদার সাংবাদিকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সমস্যার সমাধানের কোনো উপায় আছে কী?


শ্যামল দত্ত : এ অভিযোগটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যম এখনো কোনো একটা চরিত্র নেয়নি। প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই চরিত্র না নেয়ার পেছনে প্রত্যেক স্টেকহোল্ডার দায়ী, মালিকপক্ষ দায়ী, সাংবাদিকরা নিজেরাই দায়ী, যারা প্রতিষ্ঠানকে দেখভাল করবে সেই সরকারি নানারকম কনসার্ন অর্থরিটি তারাও দায়ী। এই সবাই মিলে এমন একটা ক্ষেত্র তৈরি করেছে যে অপেশাদার সাংবাদিকদের এক্সেসিবিলিটির একটা সুযোগ করে দিয়েছে। যেমন, কে সাংবাদিক, কে মালিক, কে সম্পাদক এদের কি কোনো নীতিমালা আছে? উত্তর হবে নাই। যার জন্য যে কেউ বলতে পারেন কালকে আমি সম্পাদক, মালিক বা সাংবাদিক। ধরুন আপনি যখন একটা খোলা জায়গায় ঘরের দরজা বা জানালাটা ‍খুলে দেবেন, তখন সেখানে মুক্ত বাতাস যেমন আসবে, তার সাথে ময়লাও আসবে। তার মধ্যে কীটপতঙ্গ আসবে ও মশা-মাছি আসবে। তার জন্য আপনাকে কী দিতে হবে? একটা ছাকনি বা নেট দিতে হবে। তাতে শুধু মুক্ত বাতাস আসবে কিন্তু বাকি কিছু আসবে না। সে নেট বা ছাকনিটা কী? সেটা হলো পলিসি বা নীতি। আপনি তো সে নীতিটা দেননি। আপনি যদি কাল গিয়ে বলেন যে এ পত্রিকার মালিকা বের করবো, তাহলে আপনি পেতে পারেন। খুঁজ নিয়ে দেখাই হবে না যে, আপনার কী যোগ্যতা আছে। ফলে আপনার দরজাটা খুলে দিলেন। দরজা খুলে দিয়েই যদি বলেন এখানে শুধু মুক্ত বাতাস আসবে, তাহলে তো হবে না। এই জায়গাতে আমি আপনার সাথে একমত যে, পেশাদারিত্বের জায়গা যদি ঠিক করতে হয়, তাহলে দরজাটাতে মুক্ত বাতাস আসার জন্য একটা নেট বা নীতি দিতে হবে। যাতে মুক্ত বাতাস আসবে আর পরিচ্ছন্ন হয়ে আসবে। আর যতক্ষণ এটা দেবেন না, ততক্ষণ ঘরে বাতাসও ঢুকবে, সেইসাথে পোকা-মাকড়ও ঢুকবে।


বিবার্তা: আগের তুলনায় দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন কিছুটা কমে গেছে। কেনো কমে যাচ্ছে, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?


শ্যামল দত্ত : দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। আর এখন এটি অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই ধরনের সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেখানে থাকবে একটা সহনশীল পরিবেশ। আমাদের সমাজে তো আর কোনো সহনশীলতা নেই। এই সমাজটা এমনভাবে বিভক্ত হয়েছে যে, এখানে হয় আপনি আমার পক্ষে, না হয় আমার বিপক্ষে। মাঝখানে কোনো জায়গা নেই। মাঝখানের এই জায়গাটি খুবই দরকার গণমাধ্যমের জন্য। বিশেষ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য। যেটি থাকবে মাঝামাঝি অবস্থানে। আমি এদিকেও না, ওই দিকেও না। আমি ডান দিকেও না, বাম দিকেও না। আমি মাঝখানে অবস্থান করে দুই দিকেই পর্যবেক্ষণ করবো। আর এই পর্যবেক্ষণ করেই সামনের দিকে অগ্রসর হবো। এটাই গণমাধ্যমের নিয়ম। এটাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নিয়ম। অন্যদিকে, আপনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করলে আপনার ওপরে খড়গের মতো ঝুলছে নানারকম আইন। তার চেয়ে জরুরি হচ্ছে আপনার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নেই।


সেই অর্থে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে গণমাধ্যমের জন্য খুবই কঠিন সময় হয়ে গেছে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা। তারপরও যে হচ্ছে না, তা নয়। এরপরেও দেখবেন এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে যা কিছু অন্যায়-অবিচার হচ্ছে তা কিন্তু গণমাধ্যমই তুলে ধরছে। সীমাবদ্ধতার জায়গাটি চিহ্নিত করেও বলবো, আমাদের আরো বেশি হওয়া উচিত ছিলো। এই কাজগুলোর জন্য আমরা পারছি না। আমরা পারছি না মালিকানার কারণে। মালিক বা তাদের স্বার্থের সঙ্গে যেটা দ্বন্দ্ব করে সেটা করতে দেয় না। রাজনৈতিক মহল তাদের স্বার্থের সাথে যেটা দ্বন্দ্ব করে সেটা চায় না আপনি এটা করেন। চাপ সৃষ্টি করে। আরেকটা আছে সেলফ সেনসিয়েশন। বলতে গেলে ধর্মীয় স্পর্শকাতর অনেক বিষয় আমি ইচ্ছে করে এড়িয়ে চলি। কারণ আমি জানি যে এটার অনেক ফলভোগ হবে। সুতরাং এই বাঁধাগুলো অতিক্রম করে আপনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করবেন কি, করবেন না, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করে। আসলে এটা অনেক কঠিন একটা বাস্তবতা।


বিবার্তা : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ, দৈনিক ভোরের কাগজের বিশেষত্ব কী? পাঠকরা ভোরের কাগজ পড়বেন কেন?


শ্যামল দত্ত : দৈনিক ভোরের কাগজ ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয়। আমরা একদল তরুণ নতুন সাংবাদিকতার চিন্তা-ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিলাম পত্রিকাটি। সে জায়গাতে আমরা সে সময় বেশ সফলও হয়েছি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে আমরা একটা নাড়া দিতে পেরেছি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্যাটার্নটাকে পাল্টে দিয়েছিল দৈনিক ভোরের কাগজ। তারও আগের কথা যদি বলি, এর আগের বছর যখন আমরা আজকের কাগজ শুরু করি, তখন থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। সেই গ্রুপটাই পরবর্তীতে দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করে। এখন যেটা দাঁড়িয়েছে ভোরের কাগজের ওই গ্রুপটা বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেটা প্রিন্ট মিডিয়া কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াই বলেন। সুনির্দিষ্ট করে নাম বলতে চাই না। আমি হিসেব করে দেখেছি প্রায় ২০-২৫ প্রতিষ্ঠানের সিইও আছেন, যারা কেউ হয়তো সম্পাদক, না কেউ প্রধান বার্তা সম্পাদক, কেউ চিফ এডিটর দায়িত্বে আছেন। তারা সবাই একসঙ্গে ভোরের কাগজে কাজ করে গেছেন। তারা এখন গণমাধ্যমকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।


আমরা একটা পরিচ্ছন্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা যেটা আমাদের মৌল অর্জন স্বাধীনতার, সে জায়গা থেকে আমরা একটা কাগজ প্রকাশ করছি। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে কাগজের সার্কুলেশনের ব্যাপারটা এখন আপেক্ষিক। আমাদের অনেক রিপোর্ট আছে যেটি অনলাইনে প্রকাশ করা হয়, সেটি কয়েক লাখ লোক পড়ে। এখন প্রিন্ট এবং অনলাইন মিলিয়ে একটা বাস্তবতা দাঁড়িয়ে গেছে। পাঠকের স্বভাব পাল্টে গেছে। যেমন আমাদের সারাদেশের অনেক সংবাদদাতা আছেন যারা বলেন, নিউজটা যদি পত্রিকায় দিতে না পারেন তাহলে অনলাইনে দিয়ে দিয়েন। কারণ পাঠকরা এখন আর প্রিন্টের জন্য অপেক্ষা করেন না। ফলে এখন একটা মিশ্র পাঠক গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে, যারা হয়তো পত্রিকা নিয়ে বসেন কিন্তু এখন আর তাদের পত্রিকা পড়ার সময় নেই। তারা নিউজটা এখন মোবাইলেই দেখে নেন। আমরা যে জায়গাটা করতে চাই সেটা হলো আমাদের প্রিন্ট সংখ্যাটা হতে হবে একবারে কোয়ালিটিফুল প্রোডাকশন। এর মধ্যে কোনো সম্প্রদায়ের গন্ধ থাকবে না। এর মধ্যে কোনো ধর্মীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি আঘাত করার কিছু থাকবে না। সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে কোনো আপস থাকবে না। আমাদের সংবিধানের প্রশ্নে কোনো আপস থাকবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, সে প্রশ্নে কোনো আপস থাকবে না। এগুলো ঠিক রেখেই আমরা পাঠকদের ভালো গুণগতমানসম্পন্ন একটা কাগজ ‍উপহার দিতে চাই। এটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।


বিবার্তা : তিন দশকে এখন ভোরের কাগজ। অর্জনের ঝুলিটাও বেশ বড়। এ বিষয়ে সংক্ষেপে যদি কিছু বলতেন।


শ্যামল দত্ত : আমরা একটা সামাজিক সচেতনতা তৈরি করি এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমরা মনে করি যে, একটা সামাজের মানুষের মনস্তত্ত্ব তৈরির ক্ষেত্রে কাজ করছি। বিভিন্ন সময় মানুষের সাথে কথা বলার সময় অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, অনেকে ভাবেন যে, আর কেউ থাকুক আর না থাকুক, আপনি আমাদের পক্ষে আছেন। আপনার পত্রিকা আমাদের পক্ষে আছে। আমরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। আমরা কখনো ধর্ষণকারীর পক্ষে দাঁড়াই না। আমরা কখনো ভূমি দখলকারীর পক্ষে দাঁড়াই না। আমরা কখনো রাজাকার, আলবদর তাদের পক্ষে দাঁড়াই না। এসব প্রশ্নে আমাদের অবস্থান একেবারে পরিষ্কার। ফলে আমি মনে করি যে, সারাদেশের মানুষের মধ্যে ভোরের কাগজের বিষয়ে অসম্ভব একটা ভালো চেতনা রয়েছে। সে চেতনাটাকে ধারণ করেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।


বিবার্তা/গমেজ/আরকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com