
মাইল্ড স্ট্রোক মস্তিষ্কজনিত একটি রোগ। একে মিনি স্ট্রোকও বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহে জমাট বেঁধে এক ধরনের বাঁধার সৃষ্টি করে যার ফলে রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলা হয় স্কিমিক অ্যাটাক বা টিআইএ।
এমন যদি হয় তাহলে যদিও মস্তিষ্ক সামান্য পরিমানে রক্ত ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু মস্তিস্কের কোষসমূহ অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় অক্সিজেন ও শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই এই কোষগুলো মরতে শুরু করে। আবার মস্তিস্কের ওই কোষগুলো শরীরের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ওই অংশ প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।
মাইল্ড স্ট্রোক করলে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, অবশ্য পরে আবার এটি চালু হয়।
দুই ধরনের মাইল্ড স্ট্রোক হতে পারে,যেমন: হেমোরেজিক স্ট্রোক ও স্কিমিক স্ট্রোক । হেমোরেজিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে, তবে স্কিমিক স্ট্রোকে রক্তক্ষরণ হয় না ।
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়বেটিকস, ধূমপান বা যে কোন ধরনের অ্যালকোহল থেকে এই ধরণের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রতিরোধে আগে থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
চিকিৎসকরা মনে করেন, মাইল্ড স্ট্রোক থেকে বড় ধরনের স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে মাইল্ড স্ট্রোক করা রোগীর শতকরা ৫ শতাংশই পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বড় ধরনের স্ট্রোকের সম্মুখীন হয়।
স্ট্রোকের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কিংবা আঞ্চলিকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়া দুই অবস্থাতেই প্রায় একই ধরনের লক্ষ্মণ বা উপসর্গ দেখা যায়। স্ট্রোক হলে সাধারণত যেসব লক্ষণ বা উপসর্গসমূহ দেখা যায় সেগুলো হল, মাথা ঝিমঝিম করা, প্রচণ্ড মাথা ব্যথার সাথে ঘাড়, মুখ এবং দুই চোখের মাঝখান পর্যন্ত ব্যথা হওয়া, হাঁটতে কিংবা চলাফেরা করতে এবং শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হওয়া, কথাবার্তা জড়িয়ে যাওয়া এবং অস্পষ্ট শোনানো, শরীরের একপাশে দূর্বল, অসাড় কিংবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া, চোখে অস্পষ্ট দেখা, অন্ধকার দেখা কিংবা ডাবল ডাবল দেখা, বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া ইত্যাদি।
স্ট্রোক হওয়ার পর করণীয়
শরীরের কোনো একদিকে দুর্বলতাবোধ করা বা শরীরের কোনো একদিক নাড়াতে না পারা, হাত-পায়ে অবশ ভাব, মুখ একদিকে বেঁকে যাওয়া, প্রচ- মাথাব্যথা হওয়া, কথা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া, বমি হওয়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, মুখের অসাড়তা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, বেসামাল হাঁটাচলা, হঠাৎ খিঁচুনি বা ধপ করে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলে বুঝতে হবে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন হলে রোগীকে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। এ অবস্থায় কোনো খাবার বা ওষুধ মুখে দেয়া যাবে না। কারণ এগুলো শ্বাসনালিতে ঢুকে আরও ক্ষতি করতে পারে। বরং মুখে জমে থাকা লালা, বমি পরিষ্কার করে দিতে হবে। টাইট জামা-কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার সময় খেয়াল করে রোগীর আগের চিকিৎসার ফাইল সঙ্গে নিতে হবে।
স্ট্রোকের পর করণীয়
অতি দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি ব্রেইনের রেডিওলজিক টেস্ট, সিটিস্ক্যান, এমআরআই করা উচিত। ঘাড়ের রক্তনালির ডপলার, হার্টের সমস্যার জন্য ইকো পরীক্ষা করা উচিত। রক্ত জমাটবাঁধার প্রবণতা পরীক্ষা করে নিতে হবে। প্রয়োজনে এনজিওগ্রাম ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষাও করতে হবে।
চিকিৎসা করাতে হবে দ্রুত
স্ট্রোক হলে আক্রান্ত এলাকার মস্তিষ্ক কোষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত সরবরাহ ২ থেকে ৫ মিনিটের বেশি বন্ধ থাকলে স্নায়ুকোষ স্থায়ীভাবে ধ্বংস হয়।
স্ট্রোকের চিকিৎসা
যেহেতু স্ট্রোক ব্রেইনের রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার জন্য হয় এবং ব্রেইন কম রক্তপ্রবাহ নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না, সেহেতু স্ট্রোকের চিকিৎসা তাৎক্ষণিকভাবে শুরু করতে ওষুধ প্রয়োগ করে রক্তের চাপ, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে। রক্তের জমাটবাঁধা অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে। প্রাথমিক ধাপ কাটিয়ে ওঠার পর বহুদিন পর্যন্ত ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। স্ট্রোক হয়েছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যাদের স্ট্রোক হতে পারে
স্ট্রোক সাধারণত ৫৫ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষদের সবচেয়ে বেশি হয়। এছাড়াও যাদের স্ট্রোক হতে পারেঃ
উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, অতিরিক্ত মোটা বা স্থূলতা ইত্যাদি রোগ থাকলে।
পারিবারিকভাবে অর্থাৎ পরিবারে কারও স্ট্রোক কিংবা হার্ট এ্যাটাক হওয়ার ইতিহাস থাকলে।
ধূমপান বা অ্যালকোহলজনিত সমস্যা থাকলে।
হৃদপিন্ডের অসুখ যেমন- নাড়ীর অস্বাভাবিক স্পন্দন, হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, হৃদপিন্ডের ত্রুটি কিংবা হৃদপিন্ডের সংক্রমণ ইত্যাদি রোগ থাকলে।
কোন হরমোন থেরাপি অথবা জন্মনিয়ন্ত্রণ ঔষধ সেবনের ফলে।
পূর্বে এক বা একাধিকবার স্ট্রোক অথবা টিআইএ হয়ে থাকলে।
স্ট্রোক প্রতিরোধে করনীয়
স্ট্রোক প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল উপায় হলো স্ট্রোকের ঝুঁকি সর্ম্পকে জানা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলা। এই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি হলো:
নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না এবং কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সঠিক নিয়মে সময়মত এবং সঠিক পরিমানে খাবার খেতে হবে।
নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রম অথবা সময় করে হাঁটা বা হালকা দৌড়াতে হবে।
শরীর যেন মুটিয়ে না যায় অর্থাৎ দেহের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
খাদ্যতালিকায় শাকসব্জী, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুটকী মাছ, দুধ, ভূষিসমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি রাখতে হবে।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা যাবে না।
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
অ্যালকোহল বা নেশাজাতীয় কোন দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
স্ট্রোকের ফলে যা হতে পারে
স্ট্রোকের ফলে বেশকিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন- শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মাংসপেশী অবশ হয়ে যাওয়া বা প্যারালাইসিস, স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, কোন কিছু বুঝতে সমস্যা হওয়া, খাবার খাওয়ায় অথবা খাবার গিলতে সমস্যা ইত্যাদি।
স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে পার্থক্য
স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। ব্রেইনে যখন রক্তক্ষরণ হয় বা রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়, তখন এটাকে ব্রেইন স্ট্রোক বলে। স্ট্রোক শুধুমাত্র ব্রেইনে হয় বলে একে ব্রেইন স্ট্রোকও বলে।
ব্রেইন স্ট্রোক হলে যদি ভুল করে অথবা না বুঝে, হার্টের ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় তাহলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। কারন- ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার ৩ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ থেরাপি আছে, যেটা সঠিক সময়ে দিতে পারলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে পারে। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীকে হার্টের ডাক্তারের কাছে এবং ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীকে ব্রেইনের ডাক্তার অর্থাৎ নিউরোলোজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
বিবার্তা/শারমিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]