ডেঙ্গু রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৩, ২২:০০
ডেঙ্গু রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো
মো. ইলিয়াস
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গুর সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৮২ জন। ডেঙ্গু রোগীর প্রচুর চাপ থাকায় হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গু ইউনিটে দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। ফলে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।


হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়ায় প্রতিনিয়ত রোগী বাড়ছে। রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধতার কারণে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে দুই সিটির ৫৫টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলায় সারাদেশে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি।



দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৯ সালে। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা সেবা দিতে রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। এবার গত পাঁচ বছরের মধ্যে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু কমাতে মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।


বর্তমানে যে সকল হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, সেখানে দ্বিগুণের বেশি রোগী রয়েছে। রোগী আরও বাড়লে চিকিৎসার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর প্রস্তুত নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরও ভয়াবহ হবে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি মশক নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারা দেশ থেকে প্রতিনিয়ত রোগীরা আসছেন। এখানেই নির্ধারিত শয্যার বিপরীত মেঝেতে এবং সিঁড়ির কোনাও রোগীদের রাখা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে এই হাসপাতাল থেকে কাউকে ফেরানো হয় না, অন্তত তারা যেন চিকিৎসা পায়। কিন্তু ডেঙ্গু চিকিৎসার অন্যতম শর্তই হচ্ছে রোগীকে মশারির ভেতর রাখতে হবে। কিন্তু সেটি এখানে করা সম্ভব হচ্ছে না- আর এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসক এবং নার্সরা বলছেন, রোগীদের প্রতিনিয়ত মশারি টানানোর জন্য বলা হচ্ছে, কিন্তু রোগীরা সেটা মানছে না। এভাবে ডেঙ্গু চিকিৎসার সঠিক গাইডলাইন মানা সম্ভব হচ্ছে না।


জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. নাজমুল হক বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। ডেঙ্গু রোগীর অনেক চাপ, হাসপাতাল ভরে গেছে। দৈনিক ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী আসে, সবমিলিয়ে বর্তমানে ভর্তি আছে ২৩০ জন।


কম বয়স্করা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অর্ধেকেরও বেশি রোগী ৩০ বছর বয়সের নিচে। তরুণরা বেশি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এখনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। রোগীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার।



মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, মুগদা হাসপাতালে দ্বিগুণেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত ৪৮১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে, এর মধ্যে ১২৩ জন শিশু।গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। প্রথমবার কোন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তিনি ক্লাসিক ডেঙ্গু সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। তখন জ্বর এবং হাত-পা ব্যথা থাকে। নতুন যে রোগী আসছে তাদের মধ্যে দুই শ্রেণির রোগী পাওয়ার যাচ্ছে। কিছু আছে ‘ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু সিনড্রোম’ জ্বর, মাথাব্যথা, প্লাটিলেট কমে যাওয়া। আর কিছু আছে ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ যেমন- রোগীদের পাতলা পায়খানা, বমি, বুকে পানি জমা, প্রচণ্ড পেট ব্যথা, খিচুনিসহ অনেকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। এবার একটু জটিল প্রকৃতির রোগী বেশি আসছে।


তিনি বলেন, যেহেতু এখন বৃষ্টি বেশি হচ্ছে তাই পরিবেশটা ডেঙ্গুর জন্য চমৎকার সময়। তাই এই সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি ব্যাপকহারের বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি হয়তোবা আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে পারছি না। একই সঙ্গে অনেকের ভেতর সচেতনতার অভাব আছে। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার না রাখা, জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও ডেঙ্গুর জীবাণুটা তৈরি হচ্ছে।


ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য কী পরামর্শ দিবেন জানতে চাইলে নিয়াতুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, যেহেতু ডেঙ্গু মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। বাসায় যদি কোনও ডেঙ্গু রোগী থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই মশারির ভেতর থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশনসহ ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে।


বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বিবার্তাকে বলেন, শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। এখানে যে সকল রোগী ভর্তি হয়েছে তাদের যে সিনড্রোম- বমি, পেটে ব্যথা, প্রচণ্ড জ্বর, কিছুই খেতে পারে না, মাথা ব্যথা, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্ত রোগীরা এখানে ভর্তি হচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে ভর্তি আছে ৬০ জন রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ১৮ জন।


ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। সাংবাদিক, মিডিয়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডাক্তার, নার্সসহ সমস্ত মানুষের চেষ্টার মাধ্যমেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ডেঙ্গুর লার্ভাকে ধ্বংস করতে হবে। ডেঙ্গু হওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা নিতে হবে। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা না থাকলে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে। সবসময় মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। বাচ্চাদের লম্বা মোজা পড়িয়ে যেন স্কুলে পাঠায় এবং আঙিনা যেন পরিষ্কার রাখে। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। সকলে যেন তাদের ঘরের কোনা পরিষ্কার রাখে- যাতে মশার কোন উপদ্রব না থাকে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুসারে, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ১ হাজার ২৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এতে মশাবাহী রোগটিতে এ বছর এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ জনে। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। এর মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে সর্বশেষ ৬ দিনে।


স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৭ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১২ হাজার ২২০ জন। আর চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৩ জন।



প্রতিবছর বর্ষাকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময়ে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।


২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরমধ্যে গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার একাধিক জরিপেও দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকা শহরের ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশি।
তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।


বিবার্তা/এমই/রোমেল/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com