পৃথিবীর অন্যসব দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রতি বছর মে দিবস আসে। আমরা নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালন করি। জোর গলায় বলি, এ দিন হলো শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন। তাদের ন্যায্য পাওনা আদায় তথা অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমিকদের অস্তিত্ব ঘোষণার দিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো আমাদের সমাজে শ্রমিকের সত্যিকার মর্যাদা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে কোনো দেশের উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে শ্রমিকরাই বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আবার তারাই সবচেয়ে বেশি শোষিত-বঞ্চিত হয়েছে। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বহু জায়গায় তাদের প্রাণ চলে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে। যুগে যুগে সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছে এসব শ্রমিকশ্রেণি। নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার রক্ষা ও দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করেছে। পেশাজীবী মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে কোনো রক্তপাত যে বৃথা যায় না, ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই মহান মে দিবস। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রমিক শ্রেণি আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।
এই মহান মে দিবস হচ্ছে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের বিজয় নিশান। এই কারণে মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আত্মত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাদের সুমহান আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে স্বীকৃতি পেয়েছে শ্রমের মর্যাদা।
শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন সর্বপ্রথম আমেরিকায় দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি করে। মিল মালিকরা তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলে মালিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘাত বাঁধে। এতে অনেক শ্রমিক নিহত হলে মিল মালিকরা তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। আর সে থেকেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাই দিনটি শ্রমিকশ্রেণির মানুষের মহান দিন।
ইতোমধ্যে মে দিবস পেরিয়েছে সোয়া শ' বছর। এত বছর পরও শ্রমিকরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। আজো সমাজে তাদের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো দেশে দেশে শ্রমিক শোষণ চলছে। তাদের দেখা হয় অবহেলার চোখে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে তারা বেশি কাজ করে থাকে।
বাংলাদেশের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে এক সময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। তাছাড়া প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা - এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। পাশাপাশি তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]