
একদা এক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, “তলাবিহীন ঝুড়ি”। আজ তার মাত্র সাড়ে চার দশক পরে, মহান বিজয় দিবসের এক শুভদিনে এসে আমাদের বলতে ইচ্ছা হয়, দেখে যান মি. কিসিঞ্জার, আপনার কথিত সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ মধ্য আয়ের দেশের আওতা ছাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে চলেছে।
সত্যি বলতে কি, নানা মাত্রায় বিপুল মানবসম্পদে পরিপূর্ণ এ দেশের চেহারাই অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আলাদা। বীর এ জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার নেতৃত্বে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং নির্ভরতায় তিনি ছিলেন জনপ্রতিনিধি হওয়ার সার্থক উদাহরণ, যা যুগ যুগ ধরে বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণা।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয় সংগীত – সবমিলিয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণায়। কিন্তু একটি জাতির জীবনে এটাই শেষ কথা নয়। জাতির স্বাধীনতা অর্জন মানচিত্র লাভের স্বাধীনতার সাথে শেষ হয়ে যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে জাতির সমুদয় অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করা স্বাধীনতার মৌল সত্য। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এ দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয় স্বাধীনতার সামগ্রিক অর্থ সে ব্যবস্থা ক্ষুণ্ন করে। এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রয়োজন হয় আর একটি শক্তির। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মতো দিনগুলোর শক্তি জাতিকে আনন্দ-বেদনার সাথে গৌরবের উপলব্ধি দেয়। গৌরবের উপলব্ধি জাতিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আশ্চর্য দিকনির্দেশনায় জাতিকে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সাথে মুক্তির সংগ্রামকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। আর এই মুক্তির সংগ্রামকে সফল করার জন্য প্রয়োজন বিজয় দিবসের। যে জাতির জীবনে বিজয় দিবস থাকে, সে জাতি পরাজিত হয় না। অমর্যাদার কাছে সে মাথা নত করে না। বন্ধ্যা সময় তাকে পিছু টেনে রাখতে পারে মাত্র; কিন্তু স্থায়ী হতে পারে না বন্ধ্যা সময়ের বন্ধ্যাত্ব। মুক্তির সংগ্রাম অপব্যবস্থায় আক্রান্ত হলে জাতিকে সংগ্রামে জয়ী হওয়ার সাহস দেবে অনাদিকাল ধরে এবং জয়ী হওয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত থাকবে সাহসী জাতির চেতনা। এ দিন জাতির সামনে মাথা নত করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
আশার কথা হচ্ছে, বিলম্বে হলেও গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্পন্ন হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জাতি দীর্ঘ সময় ধরে এ বিচারের অপেক্ষায় ছিল। এ বিচারকাজ সম্পন্ন করে জাতির আর একটি মর্যাদা ও অহংকারের জায়গা তৈরি হয়েছে। এবারের বিজয় দিবস এই প্রত্যাশাকে দৃঢ় করে তুলুক। এ দেশের মানুষ রক্ত এবং মৃত্যুকে সহজ সত্য করে পাড়ি দিয়েছে ইতিহাসের দুর্গম পথ। বারবারই বিজয়ী হয়েছে আন্দোলনে-সংগ্রামে। অর্জন করেছে অধিকারের জায়গা।
এটা ঠিক যে মানুষ তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কখনো পিছিয়ে থাকে না। কারণ, মানুষই পারে জীবনের ন্যায় ও সত্যকে পতাকার মতো উড্ডীন রাখতে। তাই মানুষের জীবনে বিজয়ের আনন্দ মানুষকে উৎসবমুখর করে তোলে। এই উৎসবমুখর জীবনের জয়গানের প্রার্থনা ধ্বনিত হচ্ছে আজকের বাংলাদেশে।
এটা অনস্বীকার্য, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ও উৎপাদন ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আশাতীতভাবে বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই এগিয়েছি। শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি অর্জন করেছি। কিন্তু এসব অর্জন ধরে রাখাটাই আমাদের আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ এবং এই চ্যালেঞ্জে জেতার কোনো বিকল্প নেই।
এবার বিজয় দিবস উদযাপন করতে গিয়ে আমাদের এই অঙ্গীকার ও শপথ নিতে হবে, যে আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, লাখো মানুষ শহীদ হয়েছিল, অসংখ্য মা-বোন পাকিস্তানি হানাদার ও তার দোসরদের হাতে নিপীড়িত হয়েছিল, সেসব মূল্যবোধ এই বাংলার মাটিতে আমরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবই।
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]