কবি-লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। সেটা তিনি লিখেছিলেন সামরিক শাসনতাড়িত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এবং প্রধানত রাষ্ট্রযন্ত্রকে লক্ষ্য করে।
হুমায়ুন আজাদ আজ আর নেই, কিন্তু তাঁর কবিসুলভ অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী আমাদের জীবনে নিস্করুণভাবে ফলে যাচ্ছে। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে কিনা বলতে পারি না, কিন্তু আমাদের সমাজ, সংসার ও মূল্যবোধের অনেক কিছু যে আজ আমাদের চোখের সামনেই নষ্ট হয়ে গেছে ও যাচ্ছে, সে তো বলাই বাহুল্য। নইলে যাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা-কলম, তাদের হাত কেন ও কীভাবে হয়ে ওঠে ঘাতকের হাত?
বলছিলাম গত শুক্রবার রাজধানীর উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরের নিহত হওয়ার কথা। ছেলেটি নিহত হওয়ার পর গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে কিশোর অপরাধের যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তাকে এককথায় ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়।
গণমাধ্যম বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোরদের ছোট ছোট অসংখ্য 'গ্যাং' গড়ে উঠেছে। নানা বিচিত্র নামে সক্রিয় এসব বখাটের প্রধান 'কাজ' - হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, ‘পার্টি’ করা এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। এতেও তাদের নষ্ট রক্তের টগবগানি না থামায় তারা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও সংঘাতে লিপ্ত হতো, যার সর্বশেষ শিকার উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির।
এসব বখাটে কিশোর এতটাই বেপরোয়া যে, আদনানকে হত্যা করার জন্য বের হওয়ার আগে তারা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি পোস্ট করে যায়। ছবিতে তাদের সবাইকে নীল রঙের পোশাকে দেখা গেছে। কারও কারও হাতে ছিল হকিস্টিক। আবার আদনানের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর প্রতিপক্ষ বখাটে দলের আরেক কিশোর পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই, তোর খুনিগো বাইর কইরা জবাই দিমু’।
এ তো রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে হত্যা অভিযান! এতো স্পর্ধা কোথায় পেলো এই নষ্ট কিশোরের দল! সংবাদমাধ্যম উত্তরার ১৯ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দার বরাত দিয়ে লিখেছে, বছর দুয়েক ধরে তারা এসব কিশোর বখাটের উৎপাত দেখে আসছেন। তাদের উচ্চগতির মোটরসাইকেলের রেস পথচারীদের আতঙ্কের কারণ ছিল। এদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ও স্কুলছাত্র। তবে দলে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং লেখাপড়া না-করা কিশোর-তরুণও আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তরার এই গ্যাং কালচার সম্পর্কে এক কিশোর খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দা বা পুলিশ - কেউ কি কিছু জানতে পারেনি? জানলে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
সবাই জানেন। না-জানার কী আছে। ওরা তো লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু করেনি। এমনকি সর্বশেষ খুনটি করতে যাওয়ার আগেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গেছে, আগামী যে কোনোদিন প্রতিপক্ষকে জবাই করার আগাম বার্তাও দিয়ে রেখেছে। এতোটা 'স্বচ্ছতা' নিশ্চিত করার পরও কেউ কিছু জানবে না, তা কি হয়?
সংবাদমাধ্যমকে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশনস) শাহ আলম বলেন, আট মাস আগে মারামারির প্রথম মামলা হওয়ার উত্তরা পুলিশ এই দুটি গ্যাংয়ের কথা জানতে পারে। তার দাবি, ‘আমরা অপরাধীদের ধরেছি। মহামান্য আদালত জামিন দিয়ে দিয়েছে।’
এরপর আর কথা থাকে না। কিন্তু অভিভাবক, তারা কী করছেন?
সংবাদমাধ্যমকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গ্যাং ছিল বলে জানি না। বখাটেদের উৎপাত আছে। যেদিন ওই ছেলেটি (আদনান) খুন হয়, তার কিছুক্ষণ পর আমি একটি দলকে হকিস্টিক নিয়ে মহড়া দিতে দেখি। আমি ভেবেছিলাম ওরাই হয়তো খুনটি করেছে, পরে শুনি এটা আরেকটা দল।’
কী নির্লিপ্ত উত্তর! বখাটে আছে জানতেন, তবে গ্যাং আছে তা জানতেন না। আর হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ পর একটি দলকে হকিস্টিক নিয়ে মহড়া দিতে দেখে তিনি ভেবেছিলেন, ওরাই হয়তো খুনটি করেছে। পরে শোনেন, এটা আরেকটা দল।
ব্যস, এতেই দায়িত্ব শেষ!
মনে হয়, এর পরেও আর কোনো কথা থাকতে পারে না।
উত্তরাকে ঢাকার অন্যতম 'অভিজাত' এলাকা বলা ও লেখা হয়। আভিজাত্যের কী ছিরি! ছেলেরা মোটরসাইকেলে চড়ে গুণ্ডামি করে বেড়ায়, হকিস্টিক হাতে খুন করে বেড়ায় আর তাদের অভিজাত পিতাঠাকুরের দল...
আসুন দেখা যাক, বখাটে ছেলেদের গর্বিত পিতৃকুল এমন কী মহৎ কাজে ব্যস্ত যে ছেলেরা কী করছে তা দেখা, এমনকী খবর নেয়ার সময়টা পর্যন্ত নেই!
এবারও শরণ নিতে হয় সংবাদপত্রের। গত ০৯ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তর তাদের প্রধান খবরে লিখেছে, শুধু এক ব্যক্তির শেল্টারে রাজধানীতে অন্তত দেড় শ’ জুয়ার স্পট চলছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এসব জুয়ার আসর খোলা থাকে। পাহারায় নিয়োজিত থাকে নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। আইনি ঝামেলা থেকে ওদের সুরক্ষা দেয় খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা। একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, একেকটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সে হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ৩০০ কোটি টাকা উড়ছে।
এর বাইরে 'অভিজাত' ক্লাবগুলোতে যারা জুয়া খেলতে আসে তাদের বেশিরভাগ সমাজের হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধজগতের গডফাদারদের আনাগোনাও আছে এসব ক্লাবে। গভীর রাতে ক্লাবগুলোতে আসতে শুরু করে বিত্তবানদের দামী গাড়ি। এদের অনেকেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি। দিনের আলোতে যাদের মুখোশ দেখে এমনটা বোঝার উপায় নেই। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাকাই সিনেমার উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে নামি-দামি মডেল ও টিভি তারকারা। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় এস্কর্ট গার্ল হিসেবে পরিচিত।
এই তো আমাদের সার্বিক অবস্থা! ধনসম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি - সবই আছে এদের। নেই শুধু পরিবারকে দেয়ার মতো অল্প কিছু সময়। তার ফল হচ্ছে এই যে, তাদের সুপুত্রের দল গ্যাং বানাচ্ছে, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে, ‘পার্টি’ করছে, রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছে, এমনকী চূড়ান্ত পর্যায়ে খুনও করছে। কিন্তু সদাব্যস্ত পিতার দল এর কিছুই জানতে পারছে না।
যেদিন এই নষ্ট কিশোরের দল ফুলে-ফলে পল্লবিত হবে, প্রাণঘাতী ক্যান্সারের দানবীয় চেহারা নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, ফ্রাংকেনস্টাইনের মতো জন্মদাতাকেই গিলে খেতে উদ্যত হবে, সেদিন তাদের ব্যস্ত 'আভিজাত্য' সব জানতে পারবে, কিন্তু তখন আর সময় থাকবে না।
শেষের সেদিন হবে ভয়ঙ্কর - কথাটি যেন আমরা কেউই ভুলে না যাই।
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]