
উজ্জ্বল নক্ষত্র মনুষ্যচোখে রাতের আঁধারেই দৃশ্যমান। বাদবাকি সময়ে সেই নক্ষত্রের শক্তি ও তেজ কিছুটা আড়ালে থাকলেও কোনোভাবেই অসামান্য নয়। মোজাফফর হোসেন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে তেমনই এক নক্ষত্র, যাকে নিঃসন্দেহে সোজা বাংলায় বলা যায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত। আজ তার গল্প জানার পালা।
পরিচয়ের প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, এ সময়ের তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষভাবে সমাদৃত, প্রশংসিত ও আলোচিত তরুণটি হচ্ছেন মোজাফফর হোসেন। কিন্তু কেন? তিনি একাধারে, ছোটগল্পকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক- একইসাথে সমালোচকও বটে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি শক্তিশালী ভূমিকায় সাহিত্যাঙ্গনে বিরাজমান। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক তার লেখা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়, তার লেখনী বলে সমকালীন সময়ের কথা, প্রতিবাদী হয়ে ওঠে নানা অসঙ্গতিতে। জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরে তার গল্প হয়ে ওঠে সাহিত্য সৌন্দর্যের প্রতিধ্বনি। তার অনুবাদ পাঠকপ্রিয় এবং সমালোচনা সাহিত্যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্যের তত্ত্ব, প্রকরণ ও শৈলী নিয়ে লেখালেখিতে তিনি সিদ্ধহস্ত।
মোজাফফর হোসেন ‘অতীত একটা ভিনদেশ’ গল্পগ্রন্থের জন্য এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার, ‘স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা’ গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার ও ‘তিমিরযাত্রা’ উপন্যাসের জন্য কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও ছোটগল্পের জন্য তিনি অরণি সাহিত্য পুরস্কার ও বৈশাখি টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন। ছোটগল্প নিয়ে তাঁর ‘পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প’ বইটি বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ‘পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প’ বইটির জন্য ব্রাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।
জন্মেছিলেন মেহেরপুরে, ১৯৮৬ সালে। খুব গ্রামীণ আবহে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। নিজের জন্ম ও জন্মস্থান সম্পর্কে মোজাফফর বলেন, মেহেরপুরে একদম গ্রামে বেড়ে উঠেছি আমি। বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা এটি। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানেই মুজিবনগরের ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার ইতিহাস। ছোটোবেলায় যখন বেড়ে উঠেছি এই ইতিহাসবোধ আমার মধ্যে জাগ্রত হয়নি। আমাদের শৈশবের সময়টা মাথায় রাখতে হবে, সেসময়ে যখন আমরা বেড়ে উঠি মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার চর্চা কম ছিল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আড়াল করার চেষ্টা ছিল। ফলে, শৈশবে উপলব্ধির সুযোগ হয়নি, আমি কোথায় বেড়ে উঠেছি, এখানে যে মুজিবনগর আমাদের গর্বের জায়গা সেই দীক্ষাটা সামাজিকভাবে পাইনি আমরা। কিন্তু পরবর্তীতে এসে উপলব্ধির সুযোগ ঘটেছে।
আরেকটি বিষয়, একদম সীমান্তবর্তী গ্রামে বেড়ে উঠেছি। বর্ডারের কাছে মানুষের জীবন-কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ হয়েছে, কখনো খুব উত্তেজনা থাকত, তা সত্ত্বেও গ্রামের খুব সহজ-সরল জীবন এইসবই আমার বেড়ে ওঠাতে দারুণ সহযোগিতা করেছে, ভেতরের গল্পগুলোকে জাগ্রত করেছে। তাগিদ অনুভব করেছি ভেতরের গল্পগুলোকে লেখনীতে নিয়ে আসার।
সাহিত্যের প্রতি এক ধরনের অনুরাগ থাকলেও, খুব পরিকল্পনামাফিক সাহিত্যের ছাত্র হয়েছিলেন তিনি, তেমনটা নয়। তবে, স্কুলজীবন থেকেই ইচ্ছা ছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার। এর কারণ, বিশ্বসাহিত্য পড়া। সাহিত্য পড়ে আলাদা চাকরি করা এমন উদ্দেশ্য ছিল না। এরপর, ইচ্ছাটা সত্যিতে পরিণত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।
সাংবাদিকতা দিয়ে পেশা জীবন শুরু করলেও বর্তমানে মোজাফফর হোসেন বাংলা একাডেমিতে অনুবাদ-কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার পেশাজীবন যেমন সাহিত্যসংশ্লিষ্ট, তেমনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখা, অলিগলি, সিঁড়ি তার পদচারণায় মুখর।
গল্পকার হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে মোজাফফর হোসেন বলেন, গল্প মানুষের থাকতে হবে, এই কথাটা চমৎকারভাবে বলেছেন চিনুয়া আচেবে, মানুষ হতে হলে অবশ্যই তার একটি গল্প থাকতে হবে। পুরো বাস্তবতাটাই গল্প, অনেকগুলো গল্পের সমষ্টি। গল্পের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে আমার মনে হল, গল্পের জগতটা আমাকে টানল। সেই গল্প কখনো কখনো বানোয়াট গল্প, ছোটোবেলায় যে গল্পগুলো আমরা শুনি পরিবারের যারা মুরুব্বি থাকে তাদের মুখে সেটা ধরনের, আরেকটা হল, আমাদের বাস্তব জগতে চোখের সামনে দেখা চরিত্রগুলো নানা গল্পের জন্ম দেয়। বাস্তব জগতে দেখা গল্পগুলো আমাকে টানতে থাকে। আমাদের অস্তিত্বটা যদি মাছের সাথে তুলনা করি বলা যায়, আমরা গল্পের মধ্যে ডুবে থাকি।
তিনি বলেন, সাহিত্য অনুরক্ত ছোটোবেলা থেকেই। স্কুলে যাওয়ার পথেই নানা বিষয় দেখতাম পর্যবেক্ষণ করতাম। লেখকসত্তা কবে বিকশিত হয়েছে এটা বলা মুশকিল। আমার সাহিত্যভাবনার কেন্দ্রে আছে গল্প। আমি লেখক হব বলে গল্প লিখছি বিষয়টি তা নয়; গল্প লিখব বলেই আমাকে লেখক হতে হয়েছে। লেখালেখি সংস্কৃতির একেবারে বাইরের মানুষ আমি। এমন একটা গ্রামীণ পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি যেখানে সাহিত্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। স্কুলে বাংলার শিক্ষকরা গদ্য-পদ্য পড়াতেন, যেমন করে অঙ্ক করাতেন অঙ্কের মাস্টার। এমন একটা সময় আমি হাতে পাই ‘গল্পগুচ্ছ’। পড়ে অনেক কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম যে, আমাকে গল্পকার হতে হবে।
তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দ্বিধা’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ‘দ্বিধা’ প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশনী। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আদিম বুদবুদ অথবা কাঁচামাটির বিগ্রহ’ প্রকাশ করেছে রাত্রি প্রকাশনী। ‘তিমিরযাত্রা’ প্রথম উপন্যাস।
মোজাফফর হোসেনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, অতীত একটি ভিনদেশ, নো ওম্যান'স ল্যান্ড, বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত প্রবন্ধ, দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য, মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নির্বাচিত ছোটগল্প, প্রবন্ধ সংগ্রহ : বিশ্বসাহিত্যের রীতি ও নির্মিতি, পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প : ছোটোগল্পের শিল্প ও রূপান্তর ইত্যাদি।
প্রবন্ধের বই ‘আলোচনা-সমালোচনা, প্রসঙ্গ কথাসাহিত্য’ ও গল্প ও গল্পবিষয়ক বই ‘বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ’। ‘বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ’ বইটির কথা আলাদা করে বলতে হয়। বইটি ইতোমধ্যে বেশ আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের বেশ কটি উল্লেখযোগ্য গল্প এখানে ধরে ধরে আলোচনা করা হয়েছে। এ ধরনের বই বাংলাদেশে এর আগে কেউ করেনি।
মোজাফফর হোসেন বলেন, পূর্বপরিকল্পিত ছক এঁকে আমি গল্প লিখতে পারি না। দেখা যায় অধিকাংশ গল্পই লিখতে লিখতে বাকবদল করে ভিন্ন একটা গল্প হয়ে গেছে। আমি গল্পটা জানি বলে লিখি না; অনেক ক্ষেত্রে গল্পটা জানতে চাই বলে লিখতে শুরু করি। পাঠক যেভাবে গল্পটা পড়তে পড়তে জানেন, আমি তেমন লিখতে লিখতে জানি। আমি সবসময় একটি ঘটনা যা বাস্তবে ঘটেছে সেটি না বলে কি কি ঘটতে পারতো সেই সম্ভাবনাগুলোর একটি বলতে চেয়েছি। তাই গল্পগুলো সরাসরি বাস্তবতা-নির্ভর না থেকে সম্ভাবনা-নির্ভর হয়ে উঠেছে।
গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি দুটো বিষয় মাথায় রাখি। এক. আমার বর্তমানের কাছে দায়বদ্ধতা। যে-কারণে আমার গল্পে বর্তমান সময়ের ত্রিমুখী শক্তি- করপোরেট শক্তি, আমলাতন্ত্রের শক্তি এবং মিডিয়া শক্তির কাছে একজন ব্যক্তির যে অবস্থান, সেটি নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দুই. ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধতা। এই ঐতিহ্য যেমন সাহিত্যিক ঐতিহ্য তেমন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও।
মোজাফফর হোসেন ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন। বিশ্বসাহিত্যের সর্বাধুনিক ধারা ও প্রবণতার সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যকে পাঠ ও বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ অবস্থানে। সাহিত্য নিয়ে তার ভবিষ্যৎ ভাবনা জানাতে বলেন, লিখে যেতে চাই যতদিন আমার কিছু বলার থাকবে। যেদিন মনে হবে পুরানো কথাগুলোই আবার বলতে হচ্ছে কিংবা অন্যেরা যা বলছেন, আমাকেও তাই বলতে হচ্ছে, সেদিন লেখালেখি বন্ধ করে দেব। তবে পাঠ চলবে আমৃত্যু।
বিবার্তা/এসবি/মাসুম
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]