'বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।' স্বামী বিবেকানন্দের এই কথাটি নিবিড় যত্নে প্রোথিত থাকে শুভবুদ্ধির ও মানবপ্রেমী শিষ্টজনের মনের গহীন কোণে। শুভচিন্তার সুপ্ত সে বীজ অঙ্কুর থেকে ডানা মেলে মানবের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে— ছায়াদানকারী বটবৃক্ষ হয়ে ওঠে সময়ে আর সুযোগের মেলবন্ধনে।
মানবাধিকারের জন্য সাহসী চিত্তে লড়াই করা এরকমই একজন আত্মপ্রতিজ্ঞ ও সংকল্পে স্থির ব্যক্তিত্ব আইনজীবী ও গবেষক ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ। জীবনের শুরু থেকেই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ও উন্নয়নে আত্মনিবেদিত তিনি। একইসাথে, মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনে, নারী-শিশুসহ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ও পরিবেশ রক্ষার কার্যক্রমে সোচ্চার এক সাহসী কণ্ঠ— নাম তার ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ।
চিরায়ত কাল ধরে সমাজে নারীদের যে সমস্যাগুলো দেখা যায়, যে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে নারীর বেড়ে ওঠা- জীবনযাপন, যে প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা পেরিয়ে নারীকে পথ চলতে হয়— মূলত সেই দৃশ্যপটগুলো যখনই সামনে এসেছে তখনই ফারজানা মাহমুদ নিজের মধ্যে তাগিদ অনুভব করেছেন সমাজের এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করার। ফারজানা মাহমুদ বলেন, আমি নিজে যে বাধাগুলো ফেইস করেছি, সেসব আমাকে ভাবিয়েছে। মনে হয়েছে আমি এই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি, প্রতিকূলতা পেরিয়ে সামনে যাচ্ছি, তাহলে যারা সমাজে অভাবগ্রস্ত বা সুবিধাবঞ্চিত তাদের কী অবস্থা? এই ভাবনা থেকে তাদের ব্যথা অনুভব করেছি। সেই থেকে আমার কাজের শুরু এবং কাজের ক্ষেত্র হিসেবে সামাজিক আন্দোলন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকে বেছে নেওয়া।
ফারজানা মাহমুদের ঢাকাতেই জন্ম। ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা। কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কুলজীবন শেষে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। মূলত এরপরই যেন পড়ালেখার শুরু হয় ফারজানা মাহমুদের। এলএলএম, বার-এট-ল', পিএইচডি- উচ্চশিক্ষার সব ধাপেই বিচরণ শুরু হয় তার। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হয়েও আইনশাস্ত্রকেই বেছে নেন পরবর্তী পড়াশোনার ক্ষেত্র হিসেবে। তার যেমন ইচ্ছা ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার, তেমনি ইচ্ছা আইনশাস্ত্র জানার, বোঝার, শেখার। কারণ একটাই, মানুষের জন্য কাজ করার সুপ্ত ইচ্ছা তখন মনের মধ্যে প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করার পর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে এলএলবি করেন। এরপর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নর্থামব্রিয়া থেকে বার ভোকেশনাল কোর্স করেন। ইউনিভার্সিটি অব লিডস থেকে আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় মানবাধিকার আইন বিষয়ে এলএলএম সম্পন্ন করেছেন ফারজানা মাহমুদ। তবে, মনে সবসময়ই ইচ্ছা ছিল পিএইচডি করার। তিনি ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ফারজানা মাহমুদ মানবাধিকার, সংখ্যালঘু এবং নারী ও শিশুদের উন্নয়নসহ পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত আছেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার কাজটিই চ্যালেঞ্জিং- সেই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এরকম যে কোনো কর্মে নারী নিযুক্ত থাকুক— যে অবস্থায়, যে পরিস্থিতিতেই সে থাকুক না কেন তাকে আলাদা করে বোঝানো হবে আপনি নারী। যত ভালো কাজই করুক নারী— হোক সরাসরি বা আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হবে সবকিছুই আপনি যোগ্যতায় পাচ্ছেন না। এটা বোঝানো হয় যে, অ্যাম্বিশন থাকা ভালো, তবে বেশি অ্যাম্বিশাস হওয়া যাবে না। নারীকে বারবারই প্রমাণ করতে হবে। অথচ এই বিষয়গুলো তার পুরুষ কলিগকে ফেইস করতে হয় না। নারীকে একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়, নিজেকে প্রমাণ করার ভয়। এই বিষয়টা মূলত আমার মধ্যে জেদ হিসেবে কাজ করে, যে কেন এমন হবে, এরকম হওয়া উচিত নয়। আর এটিই আমার প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাওয়ার উদ্যম।
ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০২২ লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও, তিনি উপদেষ্টা হিসেবে আছেন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম অর বিলিভ অ্যালাইয়েন্স এর সাথে আছেন। এছাড়াও আইনি পরামর্শক ছিলেন একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থায়। ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, ইউ এনএফপি, স্টেফেনাস অ্যালাইয়েন্স ইন্টারন্যাশনাল, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেছেন। নেপাল, চীন, ব্যাংকক, ভারত এবং শ্রীলঙ্কাসহ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনেও রয়েছে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের উদ্যম প্রসঙ্গে আরো বলেন, প্রত্যেকটা মানুষেরই মানবিক মূল্যবোধ আছে, মানুষ হিসেবে একটা মর্যাদা আছে— সেটা জেন্ডারের উপর নির্ভর করে না। আমি মেয়ে বলে সেটা পাবো না, এটা তো হতে পারে না। আর, সত্যি বলতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকাই, তার জীবন থেকেও ইনস্পিরেশন পাই। তিনি এত কাজ করেন তাকে নিশ্চয়ই আরো বেশি বাধা পেরুতে হয়। তিনি যেহেতু পারছেন আমাদেরও পারতে হবে। এইরকম একটা বোধ আমাকে সমস্ত চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে শক্তি জোগায়।
ফারজানা মাহমুদ উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রবাসে যখন ছিলেন তখন থেকেই মনে মনে জানতেন যে দেশে ফিরে আসবেন, দেশের জন্য কিছু করা চাই। বাস্তবিক অর্থে ফারজানা মাহমুদ করেনও সেরকমই। লক্ষ্য স্থির করার পর আর ফিরে তাকাননি, শুধু সামনে হেঁটেছেন স্বপ্নের মানবিক বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নারী-শিশু বা ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় মূলত কতটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে জানতে চাইলে ফারজানা মাহমুদ বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশ খুব ভালো অবস্থানে আছে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জ যথেষ্ট কম। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য অভূতপূর্ব অবস্থানে আছে। তবু সাম্প্রদায়িক চিন্তা ইদানীং একটু বেড়েই গিয়েছে বলা যায়। তবে, নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শতকরা সত্তর ভাগ মেয়ে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করছে। যদি নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশে না-ই থাকত তাহলে কি এটা পাওয়া যেত? ছাত্রীদের সরকার উপবৃত্তি দিচ্ছে, বিগত সময়ের চেয়ে অধিক হারে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেছে।
এই অত্যাধুনিক পৃথিবীতে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারী এখনও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য হয়, কীভাবে উত্তরণ জানতে চাইলে ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ বলেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নারী এখনও পণ্য হিসেবে গণ্য হয়, কখনো সেকেন্ডারি সিটিজেন হিসেবে ধরা হয়, এমনকি ঘরেও সে মূল্যহীন। কিন্তু আপনি একদিনে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন— বিষয়টা এমন নয়। ধীরে ধীরে এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে অধিকার অনেকখানি আদায় করা যায়। আবার, যোগ্যতা অর্জনে বাধা আছে এটাও ঠিক। বাধা পার করতে হবে, এখানে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই জায়গায় পরিবর্তন আনতে হলে ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে হবে, নারীর নিজের মধ্যে মোটিভেশন আনতে হবে।
ব্যারিস্টার ফারজানা মাহমুদ মানবিক পৃথিবীর স্বপ্নে পথচলা আত্মপ্রত্যয়ী এক সাহসী সৈনিক। পরিচয়ে বা গল্পে তাকে চেনা মুশকিল, সেক্ষেত্রে প্রশংসা বাক্য নিতান্তই বাহুল্য। ফারজানা মাহমুদের কাজই তার মূল পরিচয় আর মানবিক চেতনাই তার পরিচায়ক।
বিবার্তা/এসবি/রোমেল/এমজে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]