শিরোনাম
কথাসাহিত্যিক সাদিয়ার সাফল্যের কথকতা
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ১১:১৬
কথাসাহিত্যিক সাদিয়ার সাফল্যের কথকতা
অনিন্দিতা রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

'সফলতার মাপকাঠি এই সমাজ নানাভাবে নির্ধারণ করে। একজন নারী শ্রমিক ইটভাটায় কাজ করেও হয়তো তার পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটায়, পেটে ভাতের যোগান দেয়, তাদের জন্য একপ্রকার সাফল্য আনে। আবার পেশাজীবনে উঁচু পদে আসীন একজন নারীর হয়তো তার গণ্ডিতে ভিন্নরকম সাফল্য আছে। আমরা যেভাবেই সফল হতে চাই না কেন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নাই। তবে আমার মনে হয় অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নারী যেমন তার আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে পারে তেমনি চাইলে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যেও পৌঁছাতে পারে।'


নারীর সাফল্যে কোন বিষয়গুলো জরুরি সে প্রসঙ্গে বলছিলেন— দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সাদিয়া সুলতানা। সফল জীবনে নিজের স্বপ্ন, লক্ষ্য ও প্রচেষ্টার গল্প বলতে গিয়ে নারীর সাফল্য সম্পর্কে এমনই বয়ান সাদিয়ার।



পদ্মার হাওয়া-জল আর শীতলক্ষ্যার স্রোতের ঘূর্ণিতে বেড়ে ওঠা মুন্সীগঞ্জের কৃতি সন্তান সাদিয়া সুলতানা— বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দিনাজপুরে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে রংপুর ও রাজশাহীতে এবং সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিরাজগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। জুডিশিয়াল সার্ভিসের এই দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি সহকারী জজ হিসেবে প্রথম ২০০৮ সালে টাঙ্গাইল বিচার বিভাগে যোগদান করেন। বিচারক হিসেবে এখনো পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এগিয়ে চলেছেন সাদিয়া সুলতানা।


তার জন্ম ১৯৮০ সালের ৫ জুন, নারায়ণগঞ্জে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে সাদিয়ার ছোটোবেলা কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ,  শরীয়তপুরসহ আরো বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন বাবা-মায়ের হাত ধরে। ফলে, ছোটোবেলা থেকেই জীবনকে দেখেছেন কাছ থেকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, অনুভব করেছেন মানুষের ব্যথা-বেদনা। 'কিছু করতে চাই' এই বোধ তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া যাবে এমন পেশায় নিয়োজিত হতে।


কর্মজীবনের শুরুতে কর্মরত ছিলেন কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিআইডিএ)-এ। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ-এ লেকচারার হিসেবে কাজ করেছেন।  এডিডি ইন্টারন্যাশনাল-এ লিগ্যাল রিসার্চার ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর নিযুক্ত হন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে।


ছোটোবেলা থেকেই প্রত্যয়ী ও উদ্যমী সাদিয়া সুলতানা। বাবা শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বাবার সম্মান আর প্রাপ্তি জুড়ে গিয়েছিল সাদিয়ার স্বপ্নে। সেই স্বপ্নকে পুঁজি করে পথ চলা। সাফল্যের সব দুয়ার একে একে খুলে যায় তার সামনে।



তবে, বাবার মৃত্যুর পর জীবনকে দেখেছেন সবচেয়ে কঠিন রূপে আবির্ভূত হতে। তখনো স্কুল পেরোননি নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। তাছাড়া পড়াশোনা করার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হত সাদিয়া সুলতানাকে। কারণ স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের খরচ সংকুলান করতে নারায়ণগঞ্জেই শহর ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে বসবাসের ব্যবস্থা করেন তার মা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাড়ি ফিরতি সন্ধ্যায় ক্লান্তি পায়ের গতিকে শ্লথ করলেও সাদিয়ার সুলতানার সাফল্যের গতি কখনো শ্লথ হয়নি।


এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ড থেকে স্টার মার্কস পান এবং ভর্তি হন ভিকারুননিসা নূন কলেজে। এইচএসসিতে ঢাকা বোর্ডের মেধাতালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিক্ষেত্রেই শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন সাদিয়া সুলতানা।


তবে, কোন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আজকে অবস্থানে আসতে হয়েছে জানতে চাইলে সাদিয়া সুলতানার বিনয়ই প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, 'যা কিছু এখন আপনারা প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন তার সব কিছুই প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে এসেছে। প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে না পারলে সম্ভবত কিছুই পাওয়া যায় না। আর যা সহজে পাওয়া যায় তা সহজে শূন্যও হয়ে যায়।'



কথা প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সাদিয়ার আরেকটি দিক, যা তার বিচারক পরিচয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়। আর সেটি হলো, সাদিয়া সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল একজন কথাসাহিত্যিক। সাদিয়া নিজের স্বপ্ন-সংকল্পকে বাস্তবায়নের জন্য যখন নিবেদিতপ্রাণ তখন পাশাপাশি তার শিল্পী মন সুপ্ত বীজের মতো অন্তরে গ্রথিত হতে শুরু করে। আরেকটি বিশেষণ যুক্ত হয়, সাদিয়ার নামের পাশে, 'সাহিত্যিক'। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও তার কলমে এখন মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসে, উঠে আসে না জানা ইতিহাস।


ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করছেন। বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত আইন অভিধান ‘আইন-শব্দকোষ’-এ তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।



জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সমানভাবে কাজে ব্যয় করেন, চাকরি, সাহিত্য সংসারের পাশাপাশি অবসরে সেলাই করেন, বাড়ির উঠোনে সবজি ফলান, ছাদে ফুলের বাগান করেন। তার স্বামী মোহাম্মদ জুলফিকার উল্লাহ দিনাজপুরের চিফ জুডিশয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। সাদিয়া সুলতানা দুই সন্তানের জননী।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী হয়ে বিচারক হিসেবে কাজ করা কতটা কঠিন জানতে চাইলে সাদিয়া সুলতানা বলেন, 'কঠিন তো বটেই। এজলাসের চেয়ারে বসার পর পৃথিবীর কারও সামনে নারী পরিচয় ধারণ না করলেও আর দশটা কর্মজীবী মায়ের মতো সংসার-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, দুশ্চিন্তা, স্ট্রাগল আমারও থাকে। আর কর্মজীবনের ব্যস্ততার কারণে বাচ্চাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে আমি মনে করি বাংলাদেশের বিচার বিভাগে নারীদের জন্য এখনো অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। বিজ্ঞ সহকর্মীসহ বিজ্ঞ আইনজীবীগণ কখনোই নারী হিসেবে আমাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন না। আমি যখন আদালতে উঠি তখন তাদের কাছে আমি শুধুই বিচারক থাকি।'



কথাসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, 'আমার বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা সবকিছুর সঙ্গেই ছিল বই। আমার বাবার সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। স্কুলের পরীক্ষা শেষে বই, উপহারে বই, অবসরে বই-আমাদের ভাই-বোনদের সময় কেটেছে বইয়ের সঙ্গে।বই পড়ার এই অভ্যাস আমাদের বাবাই গড়ে দিয়েছিলেন। এতে কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না। বই নিয়ে থাকছি, থাকবো এটাই খুব স্বাভাবিক ছিল আমাদের জন্য। বই ছিল আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। শৈশব-কৈশোরে ঠাকুমার ঝুলি, দাদুর চশমা, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, লিম্যান ফ্র্যাঙ্ক বোমের ওজের জাদুকর থেকে শুরু করে বঙ্কিম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিমল মিত্র, বিভূতি, শংকর, অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত, শওকত ওসমান, আশাপূর্ণা দেবী, তিন গোয়েন্দা সিরিজ সবই ছিল পাঠতালিকায়। তখন তো বুঝতাম না কথাসাহিত্য কী, বুঝতাম বই আমার সঙ্গী, বই পাঠেই আনন্দ।'



সাদিয়া সুলতানার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: চক্র, ন আকারে না, ঘুমঘরের সুখ-অসুখ, মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ ও উজানজল। প্রকাশিত উপন্যাস: আমি আঁধারে থাকি, আজু মাইয়ের পৈতানের সুখ, ঈশ্বরকোল ও বিয়োগরেখা। সম্প্রতি কথাসাহিত্যে পেয়েছেন চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার। পেয়েছেন চলন্তিকা সমালোচক পুরস্কার। বিচার বিভাগ ও সাহিত্য দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও সাদিয়া সুলতানা স্বপ্ন দেখেন, তার কলম যতটা মানুষের গল্প বলবে, ততই অকুতোভয় হয়ে লিখবে সঠিক বিচারের আদেশ।


বিবার্তা/এসবি/মাসুম

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com