বাংলাদেশে প্রথম জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র, আবিষ্কারক মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১৮:১১
বাংলাদেশে প্রথম জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র, আবিষ্কারক মো. মিজানুর রহমান
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

ফেক নোট ডিটেক্টর বা জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র। বিশ্বজুড়ে জাল নোট শনাক্তকরণে অত্যাধুনিক যন্ত্র আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশে এইরকম যন্ত্র তৈরি হয় না, ফলে ব্যবহারও নেই। বাংলাদেশে জাল নোট শনাক্তকরণে এই প্রথম যন্ত্র আবিষ্কার করলেন যে ব্যক্তি, তার নাম মো. মিজানুর রহমান।


বাগেরহাটের মো. মিজানুর রহমান। জনতা ব্যাংকে কর্মরত আছেন অফিসার হিসেবে। তিনি মো. আবদুস সালাম ও হোসনেয়ারা বেগম দম্পতির সন্তান। শিক্ষাজীবনের শুরুটা বাগেরহাট ও খুলনায়। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এই যন্ত্র আবিষ্কারে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, শুধু প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন একটি যন্ত্র খুব প্রয়োজন তা অনুভব করে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন এই যন্ত্র বানাতে।



কলেজে পড়াকালীন সময়ে মফস্বল শহরের মো. মিজানুর রহমানের আগ্রহ তৈরি হয় কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার সর্ম্পকে, যারা বুঝত তাদের কাছে বুঝে নিয়ে নিজেও এই বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতেন। গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ, সাইবার সিকিউরিটিসহ আইটির বিভিন্ন কাজ করতেন। আর এই শেখাটাই কাজে লেগে যায় কর্মজীবনে প্রবেশের পর। কৌতূহল ও আগ্রহ থেকে শেখা মো. মিজানুর রহমানের এই জ্ঞান এখন চাইলেই যুক্ত হতে পারে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।


জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র তৈরিতে যে যন্ত্রাংশগুলো প্রয়োজন সেগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায় না বললেই চলে। এসব যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর ব্যাংকে যে মেশিনগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোও বিদেশ আমদানি করতে হয়। একটা মেশিন কিনতে প্রায় সাত-আট হাজার টাকা খরচ হয়। ফলে, বিষয়টি ব্যয়বহুল অনেকক্ষেত্রেই।


এইক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়, আমদানিকৃত এই যন্ত্রগুলো  টিউব লাইট সিস্টেম। এই মেশিনের সমস্যা হল কিছুদিন পর টিউব কেটে যায়। ফলে, মেশিনটি বিকল হয়ে যায় এবং ঠিক করাও সম্ভবপর হয় না। ফলে, পরবর্তীতে ওই মেশিন আর কাজে লাগানো যায় না।



এই প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, আমি জনতা ব্যাংকে যোগদানের পর খেয়াল করলাম, জাল নোট ধরার জন্য মেশিন না থাকায় আমাদের বেশ মুশকিলে পড়তে হয়। আর শাখাতে ওই টাইপ মেশিন নাই। আমি নিজেই কিছু একটা করার চিন্তা করি। আমার আগে থেকেই কম্পিউটার, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ করা ছিল। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আমি চিন্তা করলাম জাল নোট শনাক্তকরণের যন্ত্র বানানো যায় কি না চেষ্টা করে দেখি। আমদানিকৃত যন্ত্রে টিউবের যে সমস্যায় পড়তে হয়, তার বিকল্প কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। খুঁজতে শুরু করলাম,  টিউবের পরিবর্তে এলইডি পাওয়া যায় কি না। বাংলাদেশে এলইডি পাওয়া যায় না, পরে চায়না থেকে একজন ইমপোর্টারের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি এলইডি এনেছিলাম যে এটা দিয়ে আসলে কাজ হয় কি না। পরে দেখলাম যে এলইডি দিয়ে কাজটি হয়। কাজ হবার পর নিজে একটা বানাই এবং ব্যবহার করি। তারপর আমি এটা ব্যাংকের ফেসবুক গ্রুপে দিয়েছিলাম। দেয়ার পর কয়েকজন ম্যানেজার আমাকে ফোন দেন। তাদের কাছে প্রশংসা ও উৎসাহ পাই।


জাল নোট শনাক্তকরণের মেশিন প্রসঙ্গে মো. মিজানুর রহমান আরো বলেন, এই মেশিন তৈরির খরচ অনেক কম। মাত্র ১ হাজার টাকার মধ্যে বডি ছাড়া ইলেকট্রনিক্স যা কিছু আছে সব মিলে খরচ হয়। প্রতিটি ব্যাংকে গেলেই আপনি দেখবেন স্টোর রুমে ২-৩ টা পুরোনো অকেজো মেশিন ফেলে রাখা আছে। কিছুদিন পর এসব মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। তখন এসব বডি কাজে লাগানো যায়। আমি অনেক শাখার ম্যানেজারকে বললাম আপনারা এসব মেশিনের নষ্ট বডি গুলো আমার কাছে পাঠান। পরে এসব বডি পাওয়ার পর আমি ভেতরের সব পদ্ধতি ফেলে দিয়ে এলইডি পদ্ধতিতে সেট করে দেই এবং এটা ব্যাটারিতে চালে। আর আগের পদ্ধতিতে সরাসরি এসিতে চলত। নতুন পদ্ধতিতে তৈরি করা এ যন্ত্রে সহজেই মোবাইলের চার্জার দিয়ে চার্জ করা যায়। খুবই সামান্য বিদ্যুৎ খরচ করে এটা চালানো যায়। পুরোনো এসব মেশিন দেওয়ার পর জাল নোট শনাক্তকরণের বেশ কিছু মেশিন জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে বানিয়ে দিয়েছি। এরপর এ যন্ত্রটির ফাইনাল কাঠামো দাঁড় করানোর জন্য রিসেন্টলি আমি বডি বাংলাদেশেই তৈরি করেছি। গিয়ােইশিটের বডি দিয়ে দেশেই একটি বডি তৈরি করেছি। তা দিয়েই আপাতত চালাচ্ছি, খুব ভালো চলছে। কিন্তু বডি তৈরি করতে অনেক খরচ হয়ে যায়। একটা বডি তৈরি করতে ৮০০-৯০০ টাকা খরচ পরে যায়। তারপরও যে বডি বানিয়েছি জিআই শিটের বডি তো আল্লাহর রহমতে ৩০-৪০ বছরেও কিছু হবে না, জং ধরবে না, স্টিল সিট দিয়ে করা আর কি। আর টেকনোলজিটা তো খুবই উন্নত ও ভালো। এসব আমি নিজে করেছি। একটি মেশিন ৮-১০ বছরেও কিছু হবে না।



জাল নোট সনাক্তকরণের এই যন্ত্র তৈরিতে সব খরচ মিলিয়ে ২ হাজার টাকার কম খরচ হচ্ছে। একজন উৎপাদনকারী ইলেক্ট্রনিক ব্যবসায়ী মো. মিজানুর রহমানেরকে অফার করেন, আপনি টেকনোলজিটা দেন আমরা এসব মেশিন বাংলাদেশে বানাই বিদেশ থেকে আর আনার দরকার নাই। আপনি পারসেন্টেস বা বেশি অংশ নিয়েন, মো. মিজানুর রহমান এই বিষয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনায় জাননি।


মো. মিজানুর রহমান বলেন, সবাই এই জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র বানানোর পর সাধুবাদ জানিয়েছে, তবে কেউ সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। সরকার বা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি এই কাজের জন্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে ১৫০০ টাকার মধ্যে এই যন্ত্রটি বডিসহ বানিয়ে দেওয়া সম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে এর পেছনে অনেক খরচ কম। যদি কেউ সরকারিভাবে বা বৃহৎভাবে এলইডিটা আমদানি করতে পারে আর সবকিছু আমাদের দেশের। তাতে দেখা গেল আমদানি খরচটা বাঁচল, অনেক কম খরচে পণ্য পাওয়া গেল।


জাল নোট শনাক্তকরণের এই যন্ত্র নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চিন্তা করছেন কি না জানতে চাইলে মো. মিজানুর রহমান  জানান, তিনি এই মূহুর্তে সেইরকম চিন্তা করছেন না। তিনি বলেন, আমি একটা সরকারি চাকুরি করি, সে জায়গা থেকে আমি সরাসরি বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় যেতেও পারি না। যদি আমার প্রতিষ্ঠান নিয়ে নেয় তাহলে ভিন্ন কথা, হতে পারে এমন যে প্রতিষ্ঠান আমাকে এ সেক্টরের দায়িত্বটা দিল বা আইটি সেক্টরে নিয়ে গেল। তখন আমি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করলাম, তখন সরকারি ব্যাংকার হয়েই কাজ করতে পারলাম। কাজটা দেশের জন্য হল। প্রক্রিয়াটা এভাবে হতে পারে, অন্য কিছু নয়।


মিজানুর রহমান আরো বলেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন খরচ সব মিলিয়ে ১৬ থেকে ১৭শ টাকার মতো পরবে। আমাদের খুলনার বেশ কয়েকটা ব্যাংকের শাখায় আমার মেশিন চলছে। আমার ব্যাংকের খুলনা বিভাগীয় প্রধান বলেছেন, যেহেতু এটা একটা ভালো কাজ, তুমি করতেছ। যারা এ মেশিন চায় তুমি আপাতত তাদের বানিয়ে দাও নিজের মতো করে। আর আমরা আমাদের হেড অফিসে জানাব দেখি তারা কী চিন্তা ভাবনা করে। তবে কমবেশি সবসময় মেশিন থাকে আমি তৈরি করে দিচ্ছি।



যন্ত্রটি উৎপাদন করতে পারলে এবং বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে জাল নোটের দৌরাত্ম্য অবশ্যই বন্ধ হবে। এই প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন,  ধরুন, একজন মুদি ব্যবসায়ী বা পাড়ায় যার একটা ফলের দোকান আছে সে কিন্তু ৭-৮ হাজার টাকা দিয়ে এই মেশিন কিনতে পারবেন না, তার সক্ষমতা নেই। কিন্তু এ মেশিনটাই ১৫০০-২০০০ টাকায় যখন দেওয়া হবে তখন যে কেউ এ মেশিনটা কিনতে পারবেন। এই মেশিনটা কম দামে হওয়ার কারণে, আমার বেশ কয়েকজন গ্রাহকও এ মেশিনটা নিয়েছে এবং বিভিন্ন এনজিও থেকেও ‍নিয়েছে। তারা বাজারের মেশিনটা কিনতে পারে না কারণ তাদের অফিস অনুমতি দেয় না। আমি যখন তাদের মাত্র ১২০০-১৫০০ টাকায় দিয়েছি স্টিলের বডি ছাড়া পুরনো প্লাস্টিকের বডি দিয়ে দিয়েছি। তাতে অনেক কম খরচ পড়েছে। কম খরচ হওয়ার কারণে এবং বেশি উৎপাদন হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারছে। সবাই এটার যদি প্রচারণা চালায় বা পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে জাল নোটের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমে আসবে। যন্ত্রটি যখন সবার কাছে পৌঁছে যাবে তখন বিশেষ করে জাল নোটের চক্র দমে যাবে। কিন্তু এখন তো সবাই চাইলেও পারে না দাম বেশি হওয়ার কারণে। একজন মুদি বা ছোটখাটো দোকানদার কখনও এত টাকা দিয়ে এই যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু অল্প দামে পেলে কিনবে। যেমন আমার কাছে অনেকেই কিনতে আসছে, দাম কম জানে তারা।


মো. মিজানুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। প্রত্যাশা করেন এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে প্রতিটি মানুষ হবে স্মার্ট। তিনি মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া বা বাদ দিয়ে স্মার্ট হওয়া যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির সামান্য কিছু জ্ঞান প্রতিটি মানুষের মধ্যে থাকা জরুরি। সেইসাথে তথ্যপ্রযুক্তি সঠিক ও যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠুক অর্থনীতিতে স্বনির্ভর দেশ, এই প্রত্যাশা মো. মিজানুর রহমানের।


বিবার্তা/রিয়াদ/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com