
কথায় বলে, আগুন নিয়ে খেলো না। কিন্তু আগুনকে সঙ্গে নিয়েই যাদের জীবনযাপন, যারা আগুনের ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন নিমিষে— সেই নির্ভীক সৈনিক 'ফায়ার ফাইটার'। ফার্ডিনান্ড ফোচ বলেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর অস্ত্র হলো মানুষের আত্মা, যার অন্তরে রয়েছে আগুন। অন্তরের সেই সাহস ও উদ্যমের আগুন দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অগ্নিকাণ্ডে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে জীবনবাজির সর্বজন প্রশংসিত কাজের অকুতোভয় সৈনিক মো. শহিদুল ইসলাম সুমন, স্টেশন অফিসার (এল আর শাখা), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে 'ফায়ার ফাইটার’ আগুনের সাথে লড়েন। তবে ফায়ার ফাইটারের কাজ এই আবর্তে সীমাবদ্ধ করলে সেটা ভুল হবে। যেকোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনায়, আর্তমানবতার কল্যাণ, দেশসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ফায়ার ফাইটাররা। দুঃসাহসী ও অকুতোভয় ফায়ার ফাইটারদের একজন মো. শহিদুল ইসলাম সুমন।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার সন্তান শহিদুল। পড়াশোনা করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ রাইফেলস পাবলিক কলেজ, পরবর্তীতে বরিশালের সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে । এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পিজিডি ইন ফায়ার সাইন্স এন্ড ব্যাংকিং নিয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিষয়ে এমবিএ করেছেন। তারপর ২০১৬ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এ স্টেশন অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তার স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিন রাখি, মবিলাইজিং অফিসার, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ঢাকা। শহিদুল ইসলামের একমাত্র সন্তান সাবিত বিন ইসলাম, বয়স সাড়ে চার।
মো. শহিদুল ইসলাম সুমন শতাধিক অগ্নি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযানে কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য অভিযানের মধ্যে 'বুড়িগঙ্গা ট্রাজেডি', 'বনানী দুর্ঘটনা', 'উত্তরা দুর্ঘটনা', 'নৌবাহিনী দুর্ঘটনা এবং 'জামান টাওয়ার দুর্ঘটনা'। উপস্থিত ছিলেন সাম্প্রতিক বঙ্গবাজারে সংগঠিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডেও।
আই প্রমিজ ইউ, আই উইল বি ব্যাক
রাজধানী ঢাকার বনানীতে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ার (ফারুক রূপায়ণ টাওয়ার)-এ ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২২ তলা ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ক্রমেই সেটি অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয় এবং ৭০ জন আহত। ২৮ মার্চ বনানীর অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মীরা সাহসী অভিযান চালান।
স্টেশন কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম, ফায়ারম্যান সোহাগ চন্দ্র কর্মকার সুউচ্চ মই (ল্যাডার) নিয়ে প্রথম ভবনের ওপরের দিকে উঠেছিলেন। মইটি নিচ থেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন চালক মো. দেলোয়ার হোসেন। মইটি চালু করতে চার-পাঁচ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সে সময়টুকু দিতে রাজি নয়। ফলে আক্রমণ চালায় তাদের ওপর। শহিদুল ও সোহাগ মই দিয়ে ওপরে উঠে যান, কিন্তু চালক কোথায় যাবেন? ফলে মার খেতে হয় তাকে।
তখন শহিদুল ইসলামের ছেলের বয়স সবে পাঁচ মাস। তাই বনানী দুর্ঘটনায় আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর ‘স্যার, আমার পেটে বাচ্চা, আমাকে বাঁচান’ আকুতি তাঁকে আবেগপ্রবণ করে। যেকোনো মূল্যে তিনি এই নারীকে উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এই প্রসঙ্গে শহিদুল বলেন, ‘এই নারীকে উদ্ধারের পর কান্না আটকে রাখতে পারিনি। তাকে জীবিত উদ্ধার জীবনের সেরা অর্জন। খুব ইচ্ছা, ওই নারীর সন্তানের মুখ দেখার। কিন্তু তার নাম-ঠিকানা কিছুই জানি না।’ বললেন শহিদুল। যারা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন, তাদের কথা ভেবে এখনো ঘুমাতে পারেন না তিনি। ‘আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, আই প্রমিজ ইউ, আই উইল বি ব্যাক। কিন্তু তার আগেই তারা লাফিয়ে পড়েন ভবন থেকে।’
শহিদুল, আমরা বিকল্প লোক পাঠাব, তুমি নেমে আস, জীবন বাঁচাও
বনানী দুর্ঘটনার দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মাথা ঘুরছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছেন না। নিচ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বললেন, শহিদুল, আমরা বিকল্প লোক পাঠাব, তুমি নেমে আসো, জীবন বাঁচাও। কিন্তু শহিদুল নামলেন না। কারণ দীর্ঘসময় কাজ করে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন কোথায় কে কীভাবে কী অবস্থায় আছে, কী করতে হবে। নতুন কেউ এলে তার বুঝতে অনেকটা সময় লেগে যাবে, ব্যাহত হবে উদ্ধার অভিযান। এই অভিযানের শেষপর্যায়ে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। সুস্থ হয়ে নিজের নতুন জীবন তাকে যতটা আনন্দ দিয়েছিল, তারচেয়েও বড় প্রাপ্তি ছিল- ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষকে তিনি উদ্ধার করে নিরাপদে আনতে পেরেছিলেন বনানীর সেই দুর্ঘটনায়।
বুড়িগঙ্গা ট্রাজেডিতে নিখোঁজ এক লোককে ১৩ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার
শহিদুল বলেন, ২০২০ সালের ২৯ জুন সকালে বুড়িগঙ্গা নদীতে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড লঞ্চকে এমভি ময়ূর-২ ধাক্কা দিলে লঞ্চটি আড়াআড়ি হয়ে যায়। এরপর লঞ্চটির ওপর ময়ূর-২ উঠে যায়। এতে মর্নিং বার্ডের ৩৪ যাত্রীর সলিল সমাধি হয়। ওই উদ্ধার কাজে ডুবরিদের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। ১৩ ঘন্টা পর সুমন ব্যাপারী নামে এক লোককে জীবিত উদ্ধার করি। এই উদ্ধারকাজের পরপরই করোনা আক্রান্ত হন শহিদুল।
যতক্ষণ আপনার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, ততক্ষণ খাব না
জামান টাওয়ার দুর্ঘটনায় জীবনবাজি রেখে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার করে সাংবাদিকসহ ২৮ জনকে। ওই উদ্ধারকাজে ছিলেন শহিদুল সুমন। মুন্সীগঞ্জে নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে মানুষ ডুবে গেলে ডুবুরিদের সাথে উদ্ধার তৎপরতায় ছিল ফায়ার সার্ভিস। একজনের লাশ উদ্ধার হলেও আরেকজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফেরার পথে এক বৃদ্ধ তার হাত ধরে বলেন, বাবা, আপনারা কি কাজ শেষ করেছেন।' তিনি বললেন, না। দুপুর পর্যন্ত প্রবল রোদে না খেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলেন। বৃদ্ধ তার হাত ধরে কেঁদে বললেন, 'যে ছেলেটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, আমি তার বাবা।' হাতের রুটি-কলা রেখেই শহিদুল ইসলাম বললেন, 'যতক্ষণ আপনার ছেলেকে পাওয়া না যাচ্ছে, ততক্ষণ খাব না।' নতুন করে খোঁজা শুরু করলেন তারা। তারপর ছেলের নিথর দেহ তুলে দিলেন বাবার হাতে।
ফায়ার ফাইটাররা প্রতিটা দুর্ঘটনায় জীবন বাজি রেখে মানুষের জীবন বাঁচায়
বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আগুন নেভাতে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টাতে ছিলেন শহিদুল। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে- তার মধ্যে বেশ আলোচিত ঘটনা বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড। গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তাতে আহত হয়েছেন ৩৬ জন, পুড়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার দোকান। আগুনের লেলিহান শিখায় সর্বস্ব হারিয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ব্যবসায়ী। সেখানে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের উপর হামলা চালায় ক্ষিপ্ত জনতা। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করেন শহিদুলসহ আরো অনেকে।
শহিদুল জানান, কাজ করার কোনো সুযোগ ছিল না। বাতাস বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। কাজ করার অবস্থাই ছিল না।
শহিদুল বলেন, 'আমি সকাল ৬টা ১২ মিনিট থেকে ওখানে আগুনের মধ্যেই, রাত সাড়ে এগারোটায় বেরিয়েছি। টানা কাজ করেছি, বিশ্রাম নাই, রোজা রেখে টানা কাজ, যদিও পরে রোজা ভাঙতে হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা প্রতিটা দুর্ঘটনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে মানুষের জীবন বাঁচায়।
৯৯৯ এর জন্য জরুরি সেবা
গত ২৫ মার্চ রাজধানী শাহবাগে আব্দুল গণি রোডের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে লিফটে আটকা পড়েন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কর্মরত ছয় পুলিশ কনস্টেবল। খবর পেয়েই তাদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। রাত ১০টা ৭ মিনিটে তাদের উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে স্টেশন অফিসার মো. শহিদুল ইসলাম সুমনের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট পৌঁছে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নিচ তলায় মেশিনের সাহায্যে লিফটের দরজা খুলে আটকে পড়া ছয় পুলিশ সদস্যকে সুস্থ্য অবস্থায় উদ্ধার করেন তারা।
মো. শহিদুল ইসলাম সুমন যত উদ্ধারকাজে সাহসী অংশগ্রহণ করেছেন সে গল্প বলতে গেলে আসলে পাতার পর পাতা শেষ হবে। ফুরাবে না সাহসের গল্প, নির্ভীক প্রাণের জয়গান। তাই সংক্ষেপেই বলতে হচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম ও খালেদা ইয়াসমিন রাখি দম্পতির একমাত্র সন্তানের বয়স এখনো পাঁচ পেরোয়নি। প্রয়োজনের তাগিদে ও মানবিক বোধবুদ্ধি থেকে দুজনেই জীবনের ব্রত হিসেবে কাজ করে চলেছেন ফায়ার সার্ভিসে- অনেকটা যেন নিজেদের জীবনের সাথে সাথে সন্তানের জীবনও বাজি রেখেছেন তারা।
দুর্ঘটনায় অভিযানের শেষ পর্যন্ত কাজ করা, রাতের দুর্ঘটনায় সারারাত কাজ করেও সকালে পিটিক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয়। ছুটি খুবই কম, আত্মীয়-পরিজন এমনকি বাবা-মায়ের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ কমই মেলে! কোন কোন রাতে দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে করে ঘুমাতে পারেন না। উদ্ধারকাজে থাকলে কতটা শারীরিক-মানসিক ধকল যায় এবং সবমিলিয়ে পরিবারের সীমাহীন উদ্বেগের মাঝে বেঁচে থাকতে হয়, তা বলাই বাহুল্য। আত্মত্যাগের মহান ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করার এত শক্তি ও সাহস শহিদুল ইসলাম তখনি পান, যখন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মানুষটির চোখে দেখেন প্রাণফেরা হাসি।
বিবার্তা/সামিনা/রোমেল/এনএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
পদ্মা লাইফ টাওয়ার (লেভেল -১১)
১১৫, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]