বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জয় বাংলা স্লোগানে বেড়ে ওঠা অমি 'গরিবের ডাক্তার'
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ২২:৩০
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জয় বাংলা স্লোগানে বেড়ে ওঠা অমি 'গরিবের ডাক্তার'
সামিনা বিপাশা ও সাইদুল কাদের
প্রিন্ট অ-অ+

চারিদিকে শত শত মানুষ, কোমল-কঠিন প্রত্যয়ী মুখগুলো স্লোগান দিয়ে চলছে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। সেই মানুষের ভীড়ে ফ্রক পরা ছোট্ট একটা মেয়ে বাবার হাত ধরে হাঁটছে আর স্লোগান দিচ্ছে- 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু '। হেঁটে চলা চড়াই-উতরাই এর পথে প্রত্যয়ী এই স্লোগানকে বুকে ধারণ করেই আজকের গরিবের ডাক্তার শারমিন রহমান অমি।


মূলত, জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই বেড়ে উঠেছেন শারমিন রহমান অমি। প্রথমে বাবা-মায়ের মুখ থেকে কথা শেখা, এরপর জয়বাংলা স্লোগান শেখা তার ক্ষেত্রে বিষয়টা এরকমই ছিল। হাঁটতে শিখেই বাবার হাত ধরে  মিটিংয়ে যেতেন, মিছিলেও। শৈশব থেকে মিছিল-মিটিংয়ের প্রতি একটা অন্যরকম অনুভূতি আছে তার। তার বেড়ে ওঠাটাই ছিল মানুষের ভীড়ে, মানুষের সাথে, মানুষের দুঃখ-বেদনার সাথী হয়ে।


শেরপুর জেলা সদরে জন্মেছেন শারমিন রহমান অমি। তার বর্তমান কর্মক্ষেত্র শেরপুর সদরে। আছেন বিসিএস ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে৷ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে তার পোস্টিং। প্রায় চারবছর ধরে ডাক্তারি করছেন শেরপুরে। শেরপুরই তার প্রথম কর্মস্থল। শেরপুর জেলার শ্রীবরধীতে ছয়মাস কর্মরত ছিলেন, এরপর শেরপুর সদরে সাড়ে তিনবছর ধরে কাজ করছেন।


শারমিন রহমান অমির বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান আতিক এমপি। জনাব আতিউর রহমান আতিক ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য এবং টানা দুইবারের হুইপ। শারমিন রহমান অমি যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার বাবা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন।অমির মা শান্তনা বেগম। তিনি বাগরাকসা চন্দ্রকান্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মায়ের অক্লান্ত শ্রম আর অগাধ ভালোবাসাতে কেটেছে অমির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। মা এখনো তার সুখ-দুঃখের ছায়া-সঙ্গী। আর বাবা তার অনুপ্রেরণা। 



ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, সাহস ও প্রত্যয়ের কথা। আর নিজের চোখে দেখেই বড় হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কীভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাবার মুখে শুনে শুনেই শিখেছেন দেশকে ভালোবাসতে। উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়েছেন দেশের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার। নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তৈরি করাই ছিল ডা. শারমিন রহমান অমির জীবনের স্বপ্ন আর অনুপ্রেরণা ছিল তার বাবা।


অমি বলেন, বাবা ছোটবেলা থেকে একটা বিষয় আমার মাথায় দিয়েছিল "তুমি ডাক্তার হবা; শেরপুরের মানুষের জন্য ডাক্তার হবা"। কোনদিন কারো কাছ থেকে টাকা নিতে পারবা না- এই প্রতিজ্ঞা দিয়ে বাবা আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন। এইজন্য আমার বিবেকে সবসময় থাকে যে, আমি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ।


শেরপুর জেলার চিকিৎসাক্ষেত্রে অনবদ্য এক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন ডা. শারমিন রহমান অমি। কর্মক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ বিলামূল্যে সিজার করেন। প্রতিমাসে একশ থেকে দেড়শত ফ্রি-সিজার করেন। গর্ভবতী নারীদের চেকাপ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু ফ্রিতে করে থাকেন তিনি। এর জন্য যদি সরকার থেকে কোনো অনুদানমূল্য আসে তাহলে তা নেন; এছাড়া একটা টাকাও কোনো রোগীর কাছ থেকে চার্জ নেন না। এইজন্য এলাকায় তিনি 'গরীবের ডাক্তার' বলে সুপরিচিত। করোনা মহামারির যে সময়টা পুরো বিশ্ব স্তব্ধ, লকডাউন চলছে কঠোরভাবে সেসময় নিজের দেড়বছরের বাচ্চাকে বাসায় রেখে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. শারমিন রহমান অমি। মানুষের কল্যাণই তার জীবনের একমাত্র ব্রত।


শিক্ষাজীবন প্রসঙ্গে ডা. শারমিন রহমান অমি বলেন, আতিউর রহমান মডেল গার্লস ইনিস্টিউট থেকে এসএসসি পাস করি। যখন আমরা স্কুলে পড়ি তখন জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শেরপুরে গিয়েছিলেন। তখন তিনি একটা কথা বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা টাকাও ব্যাংকে রেখে যাননি; ফলে তাঁদেরকে ভালো করে পড়ালেখা করতে বলতেন। এই কথাটি আমার বাবা আমাদেরকে বলতেন যে, তোমাদেরকে আমি সম্পদ দিতে পারব না কিন্তু সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। সেই থেকে আমরা স্কুল জীবন থেকেই পড়ালেখা নিয়ে সবসময় সিরিয়াস ছিলাম। আমার বাবাও পড়ালেখার ব্যাপারে কখনও ছাড় দেননি। আমরা তিনবোনের উদ্দেশ্যে তিনি এমন দিকনির্দেশনা দিতেন।



শিক্ষা জীবনে কখনো সেকেন্ড হই নাই। ক্লাস ফাইভ-এইটে ডিস্ট্রিক্ট ফার্স্ট হয়েছিলাম এবং এসএসসিতেও গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছিলাম। এর পাশাপাশি রাজনীতিতেও বাবার সাথেই বিভিন্ন শান্তি সমাবেশে যেতাম। তখন তো ২০০১ এর দিকে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। সেসময় জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন সমাবেশে আমরা যেতাম, স্লোগান দিতাম। স্কুল জীবনটা এভাবে পার হয়েছে। এমনও হয়েছে যে একদিন সমাবেশে আমি যখন ক্লাস সেভেনে ছিলাম তখন মাথায় ঢিল ছুঁড়েছিল বিরোধী দলের লোকেরা। তখন আমার মাথায় একটি চোট লেগেছিল। পরে বাবা ব্যারিকেড পার হয়ে আমাকে কোলে নিয়ে চলে আসছিল। তখন আমার বাবা এমপি ছিলেন। সেসময় আমরা বাবাকে খুব একটা কাছে পাই নাই।


শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে অমি চলে আসেন জীবনের এক দুঃসহ সময়ের গল্পে। তার বয়ানেই বলতে গেলে ঘটনাটি এমন, রাতে দাদু বাড়ি আসতো বাবা। দাদু বাড়ি ছিল আমাদের শহর থেকে ১১ কি.মি. দূরে। আমরা সেখানে গিয়ে বাবাকে দেখে আসতাম। শহরে আসলে বাবার উপর বিএনপির নেতাকর্মীরা চড়াও হত। দুঃসময়ে এমপি থাকাবস্থায়ও আমার বাবাকে এমন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সেসময় আমার বাবার এন্টি ছিলেন কামরুজ্জামান রাজাকার। কিছুদিন আগে যার ফাঁসি হল। ঐ সময় আমাদের এলাকায় জামাতের অনেক প্রভাব ছিল। ওপেন রাস্তায় তাদেরকে (জামাতপন্থীদের) দা নিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক ভাবে জখম করতে দেখা যেত। এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছি। এতটা ভয়ঙ্কর ছিল ২০০১ সালে আমাদের এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি।


শারমিন রহমান অমি হলিক্রস কলেজে পড়েছেন। যখন কলেজে পড়েন তখন ওয়ান-ইলাভেন চলাকালীন সময়। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তখন উত্তাল। পড়ালেখার জন্য শেরপুর থেকে চলে আসেন ঢাকায়। তখন ন্যাম ভবনে এমপিদের থাকতে দেওয়া হচ্ছিল না। ঐসময় ঢাকাতে তাদের কোনো বাসা ছিল না। শেরপুরে একমাত্র বাসা ছিল। কিন্তু তার বাবা বললেন, আমি ন্যাম ভবনে থাকব। রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতির কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মুভ করা খুব কষ্টকর ছিল৷ হঠাৎ হঠাৎ পেট্রোল বোমা হামলা, আগুন সন্ত্রাস চলত। কর্মসূত্রে শেরপুরেই থাকতে হবে বলে অমির মা তাদের সাথে ঢাকায় আসেননি সেসময়। কলেজে পড়ার সময়টা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল শারমিন রহমান অমির। কিন্তু জীবনের কোনো অবস্থাতে কখনোই হাল ছাড়েননি অমি। অদম্য সাহস আর প্রচেষ্টা নিয়ে শুধু চেষ্টা করে গেছেন নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে।



২০০৮ সালে, গোল্ডেন এ+ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন শারমিন রহমান অমি। ভর্তি হন বারডেমে। এই প্রসঙ্গে শারমিন রহমান অমি বলেন, আমার দাদু ছিল কৃষক। কৃষকের ছেলে হিসেবে আমার বাবা অনেক রুট লেভেল থেকে উঠে আসেন। ছাত্রলীগের ভিপি ছিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন খুব রুট লেভেল থাকতে। আর্নিং সোর্স বলতে আলাদা কিছু ছিল না। বাবার একমাত্র পেশা ছিল রাজনীতি, নেশাও ছিল এটি। মেডিকেলে পড়তে গিয়ে দেখি আমার দশ লাখ টাকা লাগবে ভর্তির জন্য৷ তখন টাকা ছিল না দেখে আব্বু আমাকে নিয়ে শেখ হাসিনা নেত্রীর কাছে গেল। উনি নিজেই দশ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। উনার পূর্ণ অর্থায়নে আমি মেডিকেলে ভর্তি হই। তখন আমি মেডিকেল ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হই।


শারমিন রহমান অমি বলেন, আমার টার্গেট হলো, মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা আমি নিশ্চিত করব। এর বাইরে রাজনীতিতে মানুষ যদি চায় আমি নেতৃত্বে আসি তাহলে আমি রাজনৈতিক নেতৃত্বও আসব। রাজনীতি যখন করেছি তখন বিএমএতে সেন্ট্রাল কাউন্সিলর হিসেবে ছিলাম। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই পদেই আছি। এছাড়া সাচিব (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) এর আজীবন সদস্য। পাশাপাশি শেরপুর জেলা শাখার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছি।'


শারমিন রহমান অমি চান, চিকিৎসা সুবিধা পেতে শেরপুরের মানুষ যেন কোন দালালের খপ্পরে না পড়ে বা দুর্নীতির শিকার না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের জন্য যে চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন সেটা নিজ এলাকায় নিশ্চিত করাই অমির লক্ষ্য। তার মতে, সরকার নিজে থেকে গর্ভবতীদের জন্য ফ্রি সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে মানুষ কেন পাবে না, নিবে না কেন এই সেবা। শেরপুর শহরের উপজেলা ইউনিয়ন অফিসার হিসেবে সমস্ত ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কল্যাণ দফতরগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন নিষ্ঠা ও সততার সাথে সব কাজ তদারকি করার।


মানবিক চিকিৎসক হিসেবে খ্যাত শারমিন রহমান অমি কর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করার। সেই মোতাবেক এখন সকলে প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে সচেতনামূলক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এক অর্থে অফিসের কর্মীসহ এলাকার মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন তিনি। মানুষ নিশ্চিন্তে বাসায় বসে চিকিৎসা পাচ্ছে, তার কর্মীরা বাড়িতে মেডিসিন পৌঁছে দিচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের জন্যই কাজ করেন অমি। এরপর পরিবারকে সময় দেন।



শেরপুরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উঠান বৈঠক করেছেন অনেকবার। শুধুমাত্র জানানোর জন্য যে, ফ্রি সিজারের জন্য কোনো টাকা লাগবে না, ফ্রি ডেলিভারি, এভরশন, জরায়ুর পরিক্ষা, ক্যান্সার পরিক্ষা থেকে শুরু করে অনেকগুলো টেস্টের প্রয়োজন হয়- এর সবগুলু ফ্রিতে করানো হয়। এমনকি আল্ট্রাসনোগ্রাম ফ্রিতে করিয়ে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে সেবাগুলো দিচ্ছেন মানুষের কাছে তাঁর একটি সঠিক বার্তা পৌছে দেওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য৷


শারমিন রহমান অমি বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবে বাংলার নারীদের জন্য কাজ করতে চান, চান স্বাধীন বাংলাদেশে সুচিকিৎসায় প্রতিটি মানুষ বেঁচে থাকুক সুন্দর জীবন নিয়ে। আর সেই লক্ষ্যেই গরিবের ডাক্তার অমির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নেইই তার পথ চলা।


বিবার্তা/সাইদুল/এসবি/নয়ন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com