
টাঙ্গাইলের পাহাড়ি গড় অঞ্চলের শাল বনের লাল মাটিতে ছিল হরেক জাতের বন আলু । যা বনবাসীদের বিশাল খাদ্যের ভাণ্ডার। এ খাদ্যই ছিল এ জনপদের গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের খাদ্যের অন্যতম উৎস। জীবন-জীবিকার অনন্য উপাদান। স্বাদ-পুষ্টিগুণের এ আলু তোলা যেমন আনন্দের তেমনি স্থানীয়দের কাছে আদি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ মনে করে তারা। তবে সেই ঐতিহ্যে ভরা স্বাদ গুণেমানের এ আলু এখন আর সচরাচর চোখে পরেনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বালাই না থাকায় প্রাকৃতিকবন ধ্বংস হওয়ায় বিলীন হচ্ছে অফুরন্ত এ খাদ্য ভাণ্ডার। অবশিষ্ট যে বন টিকে আছে, তাতেও আগের মতো নেই হরেক জাতের বন আলু।
জানা যায়, ইতিহাস ঐতিহ্য খ্যাত মধুপুর শাল বন ছিল গভীর অরণ্যে ঘেরা। বনের চারপাশে ছিল গারো ও কোচ আদিবাসীদের বসবাস । গারো সম্প্রদায়ের খামালরা (কবিরাজ) বনের নানা গাছগাছরা দিয়ে তাদের চিকিৎসা করত। স্থানীয় বসতিরাও ভেষজ চিকিৎসা নিত। অরণ্যচারী আদিবাসীরা ভক্ষণ করত বাহারি বুনো খাবার। বনের বিশাল খাদ্য ভান্ডারে হতো তাদের বাড়তি অন্নের জোগান। খারি, গপ্পার নানা উপকরণ আহরণ হতো বন থেকেই। পুষ্টিগুণে ভরা বন আলু ছিল তাদের খাদ্যের মধ্যে অন্যতম। আদিবাসীরা তাদের ভাষায় বন আলুকে ‘থামান্দি বা থাজং’ বলে থাকে। থামান্দি আচিক শব্দ, এর অর্থ বন আলু।
প্রাকৃতিক শালবনের মধুপুর, ঘাটাইল, সখিপুর,মির্জাপুর ও কালিহাতীর একাংশে এ আলু পাওয়া যেত। লালমাটির শালবনে প্রাকৃতিকভাবে এসব আলু জন্মায়। এ আলু ছাড়াও বনের অভ্যন্তরে পাওয়া যেত বাহারি রকমের নাম জানা-অজানা অনেক ধরনের আলু। অরণ্যচারী গারোরা বনের চারপাশে বাস করার কারণে তারা এর সন্ধান পান। এক সময় জুম চাষের কারণে এসব আলুর সন্ধান পেতে সহজ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ওই সময় ছনের ছোট ঘর বা মাচাং তুলে তারা থাকার জায়গা করতেন। ছাউনিতে বনের ছন আর বনের তারাই বাঁশ কিংবা ছোট ছোট সরু আকারের ছোট গাছ দিয়ে সুন্দরভাবে বানাতেন ঘর। আগের দিনে খাবার সংকট হলেই ছুটে যেতেন বনে। অল্প সময় আলু সংগ্রহ করলেই পরিবারের অন্নের জোগান হতোকয়েক দিনের এমনটাই জানান বনাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসিরা।
মধুপুরের গায়ড়া, পীরগাছা, ধরাটি, মমিনপুর, জলছত্র, গাছাবাড়ি, ভুটিয়া ও চুনিয়াসহ বিভিন্ন গারোপল্লীতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসব অঞ্চলের গারোরা বন আলুকে তাদের গারো বা আচিক ভাষায় ‘থামান্দি বা থাজং’ বলে থাকে। তাদের মতে, গারো সম্প্রদায়ের লোকেরাই মধুপুর শালবনে প্রথম বন আলুর সন্ধান পান বলে জানা গেছে।
বন আলু সংগ্রহ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির একটা অংশ। মনের আনন্দে বা স্বাচ্ছন্দ্যে তারা তাদের দ্বিতীয় প্রধান বুনোখাদ্য আলু সংগ্রহ করত। এসব আলু সিদ্ধ করে খেত। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ছিল ভরপুর। তাদের অন্যতম উৎসব ওয়ানগালায় সালজং দেবতা বা শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করে থাকে বন আলু।অতিথি কিংবা আত্মীয়-স্বজন আপ্যায়নের জন্য বন আলু ছিল তাদের প্রধান উপকরণ। এখনো বনে বিভিন্ন জাতের বন আলু সামান্য পাওয়া যায়।
বন এলাকার আদিবাসী গারোদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, এক সময় মধুপুরের এই বনে গাতি আলু, গারো আলু, পান আলু, গইজা আলু, দুধ আলু, শিমুল আলু, কাসাবা, ধানমোচাআলুসহ বিভিন্ন ধরনের বন আলু পাওয়া যেত। এসবআলু তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও প্রিয় খাবারের তালিকায় অন্যতম।
অর্চনা নকরেক (৫০) নামে এক গারো নারী জানান , অতীতে অনেকেই এসব আলু বন থেকে সংগ্রহ করে আবারস্থানীয়ভাবে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করত। বন আলু দূরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হতো। বন আলুর বংশবিস্তারের জন্য আলু সংগ্রহের পর গাছগুলো আবার মাটিতে পুঁতে দিতেন আদিবাসীরা। আবার গাছ বেড়েউঠত। শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকত। এ আলু ফাল্গুন-চৈত্রমাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হত। রোদে শুকিয়ে ঘরে তুলে রাখা হত। প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো আলু পাওয়া যায় না।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ ডেভেলপমেন্ট কালচারাল ফোরামের সভাপতি অজয় এ মৃ বলেন, প্রাকৃতিক বন উজাড়ের ফলে বন আলু কমে গেছে। সামাজিক বনায়ন ও অন্যান্য প্রকল্পের ফলে বন ও বনের ঝোপঝাড় উজাড় হওয়ায় বন আলু জীব বৈচিত্র্য পশুপাখিও কমে যাচ্ছে। আদিবাসী ছাড়া অন্য যারা আলু তোলে বিক্রি করে তারা আলু তোলার পর গাছ লাগিয়ে দেয় না। ফলে কমছে বন আলু। তিনি বলেন সামাজিক বনায়ন বন্ধ করে প্রাকৃতিক বন বাড়াতে হবে, আলু তোলার পর আবার গাছ লাগিয়ে দিতে হবেজনসচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।
বিবার্তা/বাবু/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]