
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস 'আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি-না', সেই প্রশ্ন তুলেছেন। একই সাথে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না- এমন আশঙ্কাকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, 'তবে দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে একটি সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত'।
বর্তমান সরকারের সময় মিডিয়ায় ক্রাকডাউন (সংবাদমাধ্যমের ওপর বল প্রয়োগ) এর অভিযোগ নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস দাবি করেন, তার সরকারের সময়েই সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা ভোগ করছে সংবাদ মাধ্যম, যা আগে কখনো হয়নি।
এই অনুষ্ঠানে তিনি জানান যে, জুলাই মাসে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জুলাই চার্টার ঘোষণা করে তার ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হবে।
সংস্কারের ইস্যুগুলোতে গণভোট দেয়া হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, অনেকে মনে করেন গণভোট অর্থহীন। "কারণ অনেকেই বুঝবেন না কেন গণভোট। সে কারণে দলগুলো সবাই সম্মত হলে সেটা হবে বেশি বাস্তব ভিত্তিক।
চারদিনের সরকারি সফরে লন্ডন সফররত অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাজ্যের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রয়্যাল ইন্সটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত এক সংলাপে অংশ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এসব মন্তব্য করেছেন।
অনুষ্ঠানে জুলাই চার্টারের জন্য দলগুলোকে এক করার বদলে ভোটারদের ওপর আস্থা রাখা হচ্ছে না কেন কিংবা জনগণকে সুযোগ না দিয়ে যে ঐকমত্যের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ কি-না -এমন প্রশ্নও করা হয়েছিলো অধ্যাপক ইউনূসকে।
তবে এই সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের সাথে তার বৈঠক এখনো নিশ্চিত হয়নি।
এই অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারে তার অংশ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।
"কয়েকদিন আগে এপ্রিলের শুরুতে নির্বাচন ঘোষণা করেছেন। কিন্তু অনেক বিতর্ক। আর্মি ও কিছু রাজনীতিকরা এ বছরের মধ্যে নির্বাচন চান। আওয়ামী লীগ দল ও শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ- যেটা অন্যতম বড় দল। সব মিলিয়ে অনেকেই বলছেন, নির্বাচনটি ফ্রি ও ফেয়ার হবে না"- শুরুতে এমন প্রশ্ন করা হয় অধ্যাপক ইউনূসকে।
জবাবে তিনি বলেন, তার মতে এটা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন।
"সময় সঠিক ও জনগণ প্রস্তুত। যখন আপনি বহু বছর পর একটি নির্বাচন করছেন। সতের বছর পর আপনি একটি সত্যিকার নির্বাচন পাচ্ছেন। দেশে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে যে তারা সত্যিই ভোট দিতে যাচ্ছেন"।
তিনি বলেন, সতের বছরে ভোটাধিকার দেওয়ার বয়স হয়েছে যাদের, তারা তাদের প্রথম ভোট দিতে পারেনি।
"তারা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে ভোট দেওয়ার জন্য। তাদের কণ্ঠকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেই উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, যেটা আমরা বলছি যে নতুন বাংলাদেশ"।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামী নির্বাচনটি একটা নতুন সরকার নির্বাচনের জন্য রুটিন ভোট নয়, এটা নতুন বাংলাদেশের জন্য ভোট।
"আমরা এই অঙ্গীকারই করেছি, যেসব তরুণরা জীবন দিয়েছে তাদের স্বপ্নকে সম্মান করবো পুরনো বিদায় করবে নতুন বাংলাদেশের জন্য। আমরা পুরনো বাংলাদেশকে বিদায় বলে নতুন বাংলাদেশ তেরি করতে চাই," বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশের জন্য তারা তিনটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন- এর একটি হলো সংস্কার।
"আমরা সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে চাই। সেজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিশন করেছি। যাতে মৌলিক পরিবর্তন করা যায়। অনেক সুপারিশ এসেছে। নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান, সিভিল সার্ভিসসহ সবকিছু। আমাদের কাজ হলো সব দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা"।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "কখনো শুনেছেন এমন কমিশনের কথা? তারা সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করবে সব দল কোন সুপারিশগুলো গ্রহণ করবে। এটা কঠিন কাজ যে বাংলাদেশের রাজনীতিক ও দলগুলোর একমত হওয়া"।
প্রশ্নকর্তা এ সময় বলেন, "আমি বলবো রাজনীতিকদের জন্য একমত হওয়া কঠিন। দলগুলো তো বলতে পারে যে এটার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপাদান নেই। আপনি ভোটারদের ওপর আস্থা রাখছেন না কেন। যে কোন দলকে ভোট দেয়ার বিষয়ে আস্থা রাখা। সিদ্ধান্তের জন্য ভোটারের ওপর নির্ভর করছেন না কেন। কমিশনের চেয়ে ভোটারের কাছে যাওয়াই তো ভালো আইডিয়া'।
জবাবে তিনি বলেন, এমনটা যদি তারা পারতেন তাহলে ভালো হতো, কিন্তু অনেক জটিল বিষয় রয়েছে।
"শেষ পর্যন্ত আপনি কত টাকা দিবেন, আমি ভোট দিবো। টাকা দিবেন, ভোট দিবো। ভোটের বিষয়টি এমন হতে পারে। আমরা সেদিকে যেতে চাই না। ভোটাররা এ বিতর্ক প্রতিদিন দেখছে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সব দলের সম্মতিতে পাওয়া সুপারিশগুলো আলাদা করা এবং এরপর সব দলের সাক্ষরের মাধ্যমে এটি উদযাপন করা। জুলাই চার্টার জাতির কাছে সেটি উপস্থাপন করা হবে এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে," বলেছেন তিনি।
এরপর তাকে প্রশ্ন করা হয় "সমালোচকরা বলতে পারে যে কোনো দল চার্টারের সাথে একমত নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আওয়ামী লীগ। সুতরাং আপনি সত্যিকারভাবে জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর কোন সুযোগ দিচ্ছেন না। এটা তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এটা ঐকমত্য নয়, এটা আজকের বাংলাদেশে এটা কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ"।
এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "সেই বিতর্কও আছে। বিতর্ক হলো আওয়ামী লীগ কি একটি রাজনৈতিক দল? তারা কী এভাবে তরুণদের রাস্তায় খুন করতে পারে? এভাবে গুম করতে পারে? এভাবে টাকা চুরি করতে পারে? এখনো কী তাদের রাজনৈতিক দল বলবেন আপনি? এটা কোন জাজমেন্ট নয়, এটা বিতর্ক"।
তিনি বলেন, "রাজপথে তাদের (আওয়ামী লীগ) মিছিল ও অভ্যুত্থানের নেতাদেরসহ হুমকি-ধামকির কারণে আমরা নিরাপদ বোধ করছি না। হুমকি দিচ্ছে অভ্যুত্থানের নেতাদের। তাই জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার জন্য একটি সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তাদের নিষিদ্ধ করা হয়নি"।
কিন্তু বিচারের বিষয়টি কেন পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে দেওয়া হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার কেন এটি করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি নেননি।
"যারা আমাদের সরকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তারা আমাদের এই দায়িত্ব দিয়েছে। তারা তিনটি দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা সেটি গ্রহণ করেছি। সেজন্যই আমরা এগুলো করছি।"
এরপর সংবাদমাধ্যমের ওপর বলপ্রয়োগ বা মিডিয়ার ওপর ক্রাকডাউন চালানো হচ্ছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মি. ইউনূস বলেন, এটি একদম সত্যি নয়। "তারা আর কখনোই এমন স্বাধীনতা ভোগ করেনি"।
এই সংলাপে ভারত ও চীনের সাথে তার সরকারের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আসলেও তিনি দাবি করেছেন, সব সরকারের কাছ থেকেই তিনি সমর্থন পেয়েছেন।
ভারত কোন ক্যাপাসিটিতে সাবেক শেখ হাসিনাকে রাখছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে মি. ইউনূস বলেন, মাসের পর মাস নিষ্ঠুর ঘটনার পর ৫ই অগাস্ট এসেছে। সব ক্ষোভ এখন চলে গেছে ভারতে। কারণ শেখ হাসিনা সেখানে অবস্থান করছেন।
"আমি মোদীকে বলেছি, আপনি তাকে রাখতে চাইলে রাখেন কিন্তু আমাদের সহায়তা করুন তিনি যেন বাংলাদেশী জনগণকে উদ্দেশ্য করে কিছু না বলেন। কারণ তিনি বলছেন আর পুরো বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। মোদী বলেছেন, এটা সামাজিক মাধ্যম, আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেটা এখনো চলেছে"।
মি. ইউনূস বলেন তারা ভারতের সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়তে চান ও ভারতের সাথে কোনো সমস্যা চান না।
একজন প্রশ্নকারী অধ্যাপক ইউনূসের উদ্দেশ্যে বলেন, "৮ই আগস্ট আপনি বলেছিলেন যে, সবাইকে এক করা আপনার চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ধ্বংস হলো ছয় ঘন্টায় সিটি কর্পোরেশনের বুলডোজার দিয়ে। প্রশাসন নীরব ছিলো। এর ভিত্তিতে আপনি বিভাজন করছেন বা তাদের বাদ দিয়ে আপনি ঐক্য কীভাবে করবেন"?
জবাবে তিনি বলেন, তখন অনেক প্রশ্ন ও ইস্যু সব একসাথে এসেছিলো এবং তখন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। তাৎক্ষণিকভাবে তারা সব সামাল দিতে পারেন নি বলে জানান তিনি।
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]