
পাথর লুট করে পুরো সাদাপাথর এলাকা ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে। সে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াতেই চলছে তোলপাড়। ফেসবুক হয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়েছে। কিন্তু তার আলাদা কোনো প্রভাব নেই প্রশাসনে।
সমালোচনার মুখে এবারও যথারীতি লোক দেখানো হয়েছে। এক দিনের জন্য বন্ধ ছিল পাথর লুট। কিন্তু তা নিয়ে সারা দিনই হাসাহাসি করেছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি পরদিন থেকে ফের লাপাত্তা হবে প্রশাসন। শুরু হবে লুটের মচ্ছব।
সোমবার (১১ আগস্ট) সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘এখানে প্রশাসন থেকেও নেই। কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। যেন মগের মুল্লুক।’
সাদাপাথর এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের বিকেল থেকেই সাদাপাথরে লুটপাট শুরু করে দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকে মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রে নিউজ হলে সেটা আলোড়ন তুলে। তখন প্রশাসন দায়সারা একটা অভিযান চালায়। ওই একদিন বন্ধ থাকে পাথর উত্তোলন।
এভাবে গত ১ বছর ধরে চলছে। তবে এতদিন দিনের বেলা কম তৎপরতা দেখা গেলেও সারা রাত চলে পাথর লুটপাট। বিগত ২ সপ্তাহ ধরে প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে ২৪ ঘণ্টাই পাথর লুট চলেছে। এতে করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সাদাপাথর এলাকা প্রায় পাথর শূন্য হয়ে পড়েছে। এখন যেগুলো পড়ে আছে সেগুলো বড় আকারের নুড়ি পাথর বড়জোর। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বড় পাথর আছে। এগুলো তুলে নিতে না পারায় রয়ে গেছে। তবে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর যে পাথরের বৈচিত্রতার জন্য বিখ্যাত ছিল সেটা আর নেই। এখন কেবল জলের ধরা আর পানি ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই যেন।
ঠিক কত টাকার পাথর লুট হয়েছে সেটা নিয়ে কোনো ধারণা নেই কারো কাছে। প্রশাসনও জানে না কত টাকার পাথর লুট হয়েছে। কারো কাছে কোনো হিসেব নেই। তবে স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী, মিল মালিক, ট্রাক চালকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ধারণা অনুযায়ী প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
এদিকে পাথর লুট সাদাপাথর ফাঁকা হয়ে যাওয়া নিয়ে রবিবার কালের কণ্ঠ মাল্টিমিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর সিলেট জোড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ পারভেজের নেতৃত্বে অভিযানে নামে টাস্কফোর্স। বেলা ২টা পর্যন্ত চলে অভিযান। বিজিবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা এতে অংশ নেন। অভিযানে পাথর পরিবহনের দুটি ট্রাক্টর গাড়ি আটক ও দশটি বারকী নৌকা ধ্বংস করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত টাস্কফোর্সের অভিযান চালিয়েছে। এ সময় পাথর পরিবহনের দুটি ট্রাক্টর গাড়ি আটক ও দশটি বারকী নৌকা ধ্বংস করা হয়।’
কোম্পানীগঞ্জ পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী বাবুল বলেন, ‘লুটপাট তো এ কয়দিন ধরে চলছে না গত এক বছর ধরে অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে দিন রাত লুটযজ্ঞ চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বৈধভাবে ব্যবসা করতে পারছে না প্রকৃত ব্যবসায়ীরা।’
সাদাপাথর এলাকাকে মগের মুল্লুক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রশাসন থাকলেও লুটপাটের চিত্র দেখে প্রশাসন আছে বলে কি মনে হয়? এটা যেন মগের মুল্লুক। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কাউকে কেউ মানে না। প্রশাসনের চোখের সামনে দিনে দুপুরে পাথর লুট হচ্ছে দিনের পর দিন।’
সাদাপাথর এলাকাকে মগের মুল্লুক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রশাসন থাকলেও লুটপাটের চিত্র দেখে প্রশাসন আছে বলে কি মনে হয়? এটা যেন মগের মুল্লুক। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কাউকে কেউ মানে না। প্রশাসনের চোখের সামনে দিনে দুপুরে পাথর লুট হচ্ছে দিনের পর দিন।’
তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে সরকার পাথর মহাল বৈধভাবে ইজারা দিলে এভাবে চোখের সামনে শত শত কোটি টাকার পাথর লুট হতো না।’
কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আনোয়ার হোসেন সুমন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের খবর পাওয়ার পর ওই দিন বিকাল থেকে শুরু হয় সাদাপাথরে লুটযজ্ঞ। যা গত কয়েক দিন ধরে লুটপাট মহোৎসবের আকার ধারণ করেছে। রাতে বেশি পাথর উত্তোলন হলে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ইদানীং দিনের আলোতে কোটি কোটি টাকার পাথর লুটপাট করে পর্যটন কেন্দ্রটিকে বিরানভূমি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ থামাবার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই।
এ বিষয়ে পরিবেশকর্মী ও সুরমা ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, যেভাবে পাথর উত্তোলন হয়েছে এর প্রকৃত পরিমাণ বলা কঠিন। যেকোনোভাবে এর পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি। এটা রক্ষা করার জন্য আনসার ক্যাম্প ও পুলিশ এ সমস্ত কিছু ছিল। এখানে যাদেরকেই রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রত্যেকে দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। একজন আরেকজনের ওপর দায় চাপায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, ‘এটি রক্ষা করা প্রশাসনেরই দায়িত্ব। প্রশাসনের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব। যারা দায়িত্বশীল আছেন অর্থাৎ প্রশাসন কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখছে এটা আপনারা চিত্র দেখলেই বুঝতে পারবেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জে থেকে কি পরিমাণ পাথর লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা তার সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে সঠিক তথ্য পাবেন। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে প্রশাসনের নেতৃত্বে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। আমরা প্রায় সময় অভিযান দিয়ে পাথর উত্তোলনের ব্যবহৃত নৌকা ও গাড়িসহ পাথর উত্তোলনকারীদের আটক করে মামলা দিচ্ছি।’
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]