শিরোনাম
নওগাঁয় বধ্যভূমিগুলো গোচারণ ভূমি
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৪:২১
নওগাঁয় বধ্যভূমিগুলো গোচারণ ভূমি
আশরাফুল নয়ন, নওগাঁ
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এই রাতে নিষ্ঠুর পাকহানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরহ ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যাকাণ্ড চালায়। যা জাতি আজও ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এই প্রথমবার জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।


নওগাঁ জেলার গণহত্যা’র পরিপূর্ণ ইতিহাস কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। স্থানীয় একটি সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ নওগাঁ’ দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে নতুন নতুন কিছু তথ্য উঠে এসেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৯টির মতো গণহত্যার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।


এ গণকবরগুলোর অধিকাংশই আজও অরক্ষিত, অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। উন্মুক্ত গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিছু বধ্যভূমিতে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও একুশে পরিষদের পক্ষ থেকে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। আবার যে গুলোতে স্মৃতি ফলক রয়েছে সেগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সন্ধ্যায় জেলার ৩৯টি বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থানসমূহে একই সাথে আলোক প্রজ্জ্বলন করা হবে।


বধ্যভূমিগুলো


নওগাঁ সদর উপজেলায়
ধামকুড়ি, দোগাছি, ফতেপুর, মোহনপুর, বলিহার, আরজি-নওগাঁ, হাট-নওগাঁ, খাস-নওগাঁ ও পার-নওগাঁ।


রানীনগর উপজেলায়
আতাইকুলা, আত্রাই উপজেলার: বান্দাইখাড়া, সিংসাড়া, মিরাপুর, বৈঠাখালি, পাইকড়া, পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন, বাউল্ল্যাপাড়া, গোয়ালবাড়ি, মান্দা উপজেলার: পাকুড়িয়া, মনোহরপুর, কবুলপুর ও কিত্তলী।


বদলগাছি উপজেলায়
গয়েশপুর, ঐতিহাসিক পাহাড়পুর, চক-গোয়ালি, মহাদেবপুর উপজেলার: বাজিতপুর-চকদৌলত, মহিষবাথান, পত্নীতলার উপজেলার: নিরমইল-হালিমনগর, ধামইরহাট উপজেলার: কুলফতপুর, ফর্সিপাড়া, পাগলা দেওয়ান(নওগাঁ জেলার অংশ), নিয়ামতপুর উপজেলার: ভাবিচা, সাপাহার উপজেলার: সাপাহার, আশড়ন্দ ও পাহাড়ীপুকুর।


পোরশা উপজেলায়
শিশাহাট।


জানা যায়, ১৯৭১ সালে ১৬ এপ্রিল পাকবাহিনী রাজশাহী শহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অনেক ছোট-বড় যুদ্ধের ফলে রাজশাহীতে পাঞ্জাবি বাহিনী প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। কর্ণেল তাজের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে সৈন্য ও রসদ সংগ্রহ করে শক্তি বৃদ্ধি করে। এরপর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা দুটি দলে বিভক্ত হয়। একটি রেলপথে আর একটি নওগাঁর নওহাটা-মান্দা সড়ক পথে।


রেলপথের দলটি ২১ এপ্রিল বিশেষ ট্রেন যোগে আত্রাই স্টেশনের পার্শ্বে নদীর তীরে অবস্থান নেয়। বিকেল ৩টার দিক হবে। ঝোঁপঝাড়ে গরীব অসহায় মানুষরা বসবাস করতো ঝুপড়ি বেঁধে। পাকবাহিনীরা ঝুপড়িতে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। কিন্তু নিহতের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।


সৈন্যদের একটি দল মুক্তিবাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত আহসানগঞ্জ রেলসেতু পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে। অপর একটি দল নিকটবর্তী সাহেবগঞ্জ বাজারে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জনশূন্য ছিলো সাহেবগঞ্জ বাজার। হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।


পাকসেনারা ট্রেনেই রাত কাটিয়ে ২২শে এপ্রিল সকালে ট্রেনে করে রাণীনগরের কাছাকাছি চকের ব্রিজের নিকট পৌছে এবং রাণীনগর স্টেশনের দিকে শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। আগের রাতে নওগাঁ থেকে আনসার ও মুজাহিদদের একটি বাহিনী রাণীনগর গিয়ে শেষ রাতের দিকে চকের ব্রিজ নষ্ট করে দেয়। ব্রিজটি ভাঙ্গা দেখে ট্রেনটি সেখানে থেমে যায়।


একদল সৈন্য ট্রেন থেকে নেমে সন্নিহিত চকবলরাম, বেলবাড়ি, দাউদপুর প্রভৃতি গ্রামে আগুন ধুরিয়ে দেয় এবং সামনে কয়েক ব্যক্তিকে পেয়ে হত্যা করে। এরপর ব্রিজটি মেরামত করে সকাল ৯টার দিকে চকের ব্রিজ পেরিয়ে সান্তাহারের দিকে অগ্রসর হয়। পথে রাণীনগর স্টেশনের পূর্বপাশ পুকুরপাড়ে রাজাপুর গ্রামের সফিউদ্দিন খলিফা (৪০) ও একই গ্রামের কায়েম উদ্দিনকে (৪২) মসজিদের ধারে গুলি করে হত্যা করে।
উল্লেখ্য, রেলপথের দু’ধারে কিছু দূরত্বে বহু কৌতুহলী লোকজন সেনাবাহিনীর ট্রেনটিকে দেখছিল। কিন্তু তাদেরগুলি করেনি। তবে তারা রাণীনগর স্টেশনের নিকটস্থ দোকানগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। রাণীনগর-সান্তাহার রেলপথের পূর্বধার বগুড়া জেলার কেল্লাপাড়া গ্রামের এক বৃদ্ধ ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে। ট্রেনটি ২২ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টার সামান্য কিছু পরে সান্তাহার রেলওয়ে জংশনে প্রবেশ করে।


সৈন্যরা সান্তাহারে নিহত বিহারীদের লাশের স্তুপ প্রত্যক্ষ করে। বেঁচে যাওয়া বিহারীদের সঙ্গে আলাপ করে। অতঃপর দুপুর দেড়টার দিকে শেল নিক্ষেপ করতে করতে তাদের একটি দল নওগাঁ শহরের দিকে অগ্রসর হয়। অপর দলটি সান্তাহারে অবস্থান নেয়।


একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এমএম রাসেল বলেন, বধ্যভূমির ৩৯ স্থানে একই সময় আলোক প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে স্মৃতি ফলক নাই, সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ ও শহীদদের স্বীকৃতি প্রদান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যার দিবস সমূহ পালন করার দাবি জানান।


মুক্তিযুদ্ধকালীন আঞ্চলিক কমান্ডার ও সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান বলেন, গণহত্যা দিবসের মূল তাৎপর্য হচ্ছে হঠাৎ পাকবাহিনী নিরহ বাঙালীদের উপর আক্রমন চালিয়ে হত্যা করেছিল। সেদিন ইপিআর পুলিশ যারা ছিল যুবক সর্বস্তরের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বাঙালি জাতীর সত্যের বিকাশে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। আর গণকবরগুলোর বিষয়ে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে সেগুলো দৃষ্টি নন্দনের জন্য।


বিবার্তা/আশরাফুল/আকবর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com