শিরোনাম
রাজশাহীতে কঙ্কাল নিয়ে ভয়ঙ্কর কারবার
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:২৫
রাজশাহীতে কঙ্কাল নিয়ে ভয়ঙ্কর কারবার
রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রিন্ট অ-অ+

রাজশাহীতে কঙ্কাল নিয়ে ভয়ঙ্কর কারবারে মেতে উঠেছে একটি চক্র। এতে জড়িয়ে পড়েছে মেডিক্যাল কলেজের (রামেক) কিছু শিক্ষার্থী, মর্গের ডোম, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কয়েকজন অসাধু মালিক আর সীমান্তের কিছু চোরকারবারী।


কয়েক মাস আগেই রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় জেলা প্রশাসকের বাংলোর সামনে থেকে ১২টি কঙ্কালসহ চারজনকে আটক করেছিল পুলিশ। এরপরেও থামেনি কঙ্কালের কারবার।


সর্বশেষ মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মর্গ থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে ১৫টি মাথার খুলি ও হাড়গোড়। মর্গের দোতলার একটি কক্ষ থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল এগুলো উদ্ধার করে।


এ সময় কঙ্কাল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মর্গের দুই ডোমকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন, নগরীর বাকীর মোড় লক্ষ্মীপুর এলাকার বিপন কুমার (৫৫) ও নীরেন রবিদাস (৪২)।


নগর ডিবি পুলিশের ওসি আবদুল হান্নান জানান, রামেক মর্গে কঙ্কাল সংরক্ষণ করে কেনাবেচা হয়- এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানে মর্গের দোতলার একটি কক্ষ থেকে খণ্ড খণ্ড অবস্থায় ১৫টি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এ সময় কঙ্কাল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই দুই ডোমকে আটক করা হয়। পরে রাতেই তাদের নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করা হয়। সকালে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।


ওসি আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিপন ও নীরেন দাবি করেছে, চোরাকারবারীরা তাদের ভারত থেকে খণ্ড খণ্ড অবস্থায় কঙ্কাল এনে দেয়। তারা সেগুলোর হাড়গোড় জোড়া দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে।


তারা আরো জানায়, এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে কয়েকজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কয়েকজন মালিক এবং সীমান্ত এলাকার কিছু চোরকারবারী।


এদিকে মেডিক্যাল কলেজের মর্গে এতোগুলো কঙ্কাল পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবার্তাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীতে কঙ্কাল ব্যবসা করছে একটি শক্তিশালী চক্র। চক্রের একেক জন সদস্য নির্দিষ্ট একটি ধাপে কাজ করে। বেশিরভাগ কঙ্কাল আসছে ভারত থেকে। কিছু কঙ্কাল আসছে দেশের ভেতরে কবর থেকে চুরি হয়ে। আর কিছু কঙ্কাল মিলছে মর্গ থেকেই। পূর্ণাঙ্গ একটি কঙ্কাল তৈরিতে যেসব হাড় প্রয়োজন তা কেনা হয় পাঁচ হাজার টাকায়। আর একটি কঙ্কাল বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়।


বুধবার দুপুরে কঙ্কাল ব্যবসার আদ্যোপান্ত নিয়ে বিবার্তার সঙ্গে কথা বলেন রামেক মর্গের একজন ডোম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনিও জানিয়েছেন কঙ্কাল ব্যবসার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।


তিনি জানান, রামেক মর্গের ডোমরা বেতন পান মাসে ২০ টাকা। তাদের বাপ-দাদারাও এই বেতনই পেয়েছেন। তাই ময়নাতদন্তের পর লাশের স্বজনদের কাছ থেকে জুলুম করে টাকা আদায় করে থাকে ডোমরা। আর আয়ের পথ আরো বাড়াতে প্রায় সব ডোমই কঙ্কালের কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে তাদের দায়িত্ব খুব কম। তারা শুধু বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গলিত লাশ থেকে হাড়গোড় বের করে পরিষ্কারের পর পূর্ণাঙ্গ একটি কঙ্কাল তৈরি করে দেন। কখনও কখনও বেওয়ারিশ গলিত লাশ থেকে বের করে নেয়া হয় হাড়গোড়। তারপর গলিত মাংসের ভেতর বাঁশের কঞ্চি ভরে সেলাই করে দেয়া হয়। সেসব লাশ কেউ পরীক্ষা করে দেখে না। গলিত লাশের কোনো স্বজন থাকলেও তারা তা পরীক্ষা করেন না। ফলে এসব লাশ থেকে হাড় চুরি করা তাদের জন্য অনেক সহজ।


তিনি আরও জানান, চোরাই চক্রের সদস্য হিসেবে রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে কিছু মাদকসেবী লাশ চোর আছে। তারা কবরস্থান থেকে লাশের হাড়গোড় চুরি করে এনে ডোমদের হাতে দেয়। তবে সিংহভাগ কঙ্কাল আসে রাজশাহীর চর মাঝাড়দিয়াড় সীমান্তপথে ভারত থেকে। ওই গ্রামের উজ্জল, সুকচাঁন, আরিফুল, ফজলু, লিটন, মাজান, মুন, মুরোজা ও শরিফুলসহ অন্তত ২০ জন চোরাকারবারী আছে, যাদের কাজ শুধু কঙ্কাল আনা। তারাই রামেকের ডোমদের হাতে কঙ্কালগুলো পৌঁছে দেয়। মাঝাড়দিয়াড়ের সীমান্ত এলাকার ভারতীয় গ্রামগুলোর চোরাকারবারীরা ওই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের হাড় সংগ্রহ করে এপারের চোরাকারবারীদের হাতে তুলে দেয়।


সূত্র আরও জানায়, রামেকের মর্গের ডোমেরা খণ্ড খণ্ড হাড় ও মাথার খুলি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল তৈরী করেন। তারপর চাহিদামতো এসব কঙ্কাল নিয়ে যান নগরীর লক্ষ্মীপুর কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিক আলমগীর হোসেন, লক্ষ্মীপুর জিপিও এলাকার মামুন ওরফে কানা মামুন, ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী আবদুস সবুর, বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী রায়হান ও ওয়াহেদ এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা মিনহাজুল। তারা একেকটি কঙ্কাল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিভিন্ন বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে, মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এবং সায়েন্টিফিক দোকানে বিক্রি করেন। প্রতিটি কঙ্কালের কাজ করে দেয়ার জন্য ডোমদের দেয়া হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা।


মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কঙ্কাল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া এবং মর্গে কঙ্কাল নিয়ে এমন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কথা বলতে বুধবার বিকেলে রামেকের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মাসুম হাবিবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


রাজশাহী নগর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আবদুল হান্নান বলেন, মঙ্গলবার ১৫টি কঙ্কালসহ দুই ডোমকে গ্রেফতারের পর তারাও পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, মেডিক্যাল কলেজেরই কিছু শিক্ষার্থী কঙ্কালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। কিছু কঙ্কাল সীমান্তপথে ভারত থেকে মর্গে আসছে। আবার কিছু আসছে কবর থেকে। কিছু হাড়গোড় বেওয়ারিশ লাশের শরীর থেকেও ময়নাতদন্তের সময় বের করে নেয়া হয়। কঙ্কাল ব্যবসার পুরো চক্রটি সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছে পুলিশ। তাদের সবার দিকে নজরদারি করা হচ্ছে।


বিবার্তা/রিমন/পলাশ/নাজিম

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com