পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আখ চাষ
খরচ ও পরিশ্রম কম, লাভও বেশি
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:৩৫
খরচ ও পরিশ্রম কম, লাভও বেশি
লামা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

রূপ-লাবণ্যের শহর হিসেবে পরিচিত পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। এ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হলো লামা ও আলীকদম। এই দুই উপজেলার অধিকাংশ ফসলি জমিতে যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে তামাক চাষ। এ তামাক ক্ষতিকারক হওয়া সত্ত্বেও বেশি লাভজনক হওয়ায় এবং তামাকজাত কোম্পানি থেকে অগ্রিম অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ায় এখানের কৃষকেরা পণ্যটি চাষ
করছেন।


এ চাষে কৃষক, মাটি ও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে -এমন আভাসে তামাক আগ্রাসন রুখে দিতে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ শুরু করে সরকার। এ ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ -এর আওতায় তামাক চাষের বিকল্প আখ চাষ শুরু করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ সহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।


ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় দুই উপজেলায় ৪৫ জন কৃষকের মাধ্যমে ৪৫টি প্লটের মাধ্যমে ৪৫ বিঘা জমিতে আখ চাষ করা হয়। শুধু লামা ও আলীকদম উপজেলায় নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২২-২০২৩ রোপণ মৌসুমে জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, থানছি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় আরও ৮৫ জন কৃষকদের মাঝে ৮৫ বিঘা জমিতে ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে।


প্রদর্শনী প্লট সমূহের উন্নতমানের শোধনকৃত আখের বীজ, সাথী ফসল বীজ, সার-কীটনাশক বিতরণ এবং প্রদর্শনী প্রাপ্ত কৃষক ও অন্যান্য কৃষকদেরকে যথাসময়ে মাঠ দিবসসহ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিতও করা হয়।


চলতি মৌসুমে এ চাষে বাম্পার ফলনে লাভের মুখ দেখা দেওয়ায় চাষিরা বেজায় খুশি। স্বল্প খরচ, অধিক লাভ ও পরিশ্রমও কম হওয়ার কারণে বর্তমানে এ জেলার অন্য কৃষকেরাও আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছেন। সচেতন মহলের অভিমত, তামাকের বিকল্প হতে পারে আখ চাষ। তাই এ চাষ বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগকেও কৃষকদের সহায়তা প্রদান অপরিহার্য। চলতি মৌসুমে ৮০ জন প্রকৃত তামাক চাষিকে ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।


এবারে জেলায় মোট ১৩০ কৃষক প্রতি বিঘা হারে ১৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। জেলায় বাৎসরিক গুড়ের চাহিদা ২৮ টন, উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৪ টন। আরো ২৬ টন গুড়ের ঘাটতি রয়েছে। এ হিসেবে জেলায় আখ চাষ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে বলে দাবি করেন মানবাধিকার কর্মী এম. রুহুল আমিন।


তিনি বলেন, আখ চাষ বাড়াতে উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি কৃষি বিভাগকেও এগিয়ে আসতে হবে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত চার যুগের বেশি সময় ধরে লামা উপজেলার ১টি পৌরসভা, ৭টি ইউনিয়ন ও পাশের আলীকদম উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন সহ পুরো জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আবাদি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানেও বেশির ভাগ জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। তামাক চাষ লাভবান হলেও শারীরিকভাবে ক্ষতি হয়।


এছাড়া পরিশ্রম এবং মূলধন বেশি লাগার কারণে আস্তে আস্তে অনেক কৃষকই সম্প্রতিকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্বুদ্ধকরণে ক্ষতিকর তামাক চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তারা তামাকের বিকল্প বেচে নিচ্ছেন আখ চাষকে। এক সময় যে সকল কৃষক ক্ষতিকর তামাক চাষ করতেন তাদের অনেকেই এখন আখ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন বলে জানান কৃষি বিভাগ।


সাধারণত বছরের আগস্ট মাসে আখ রোপণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কৃষকদের তামাক চাষ থেকে ফেরাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ -এর আওতায় ২০২২-২৩ রোপণ মৌসুমে লামা উপজেলায় ২৫ জন ও আলীকদম উপজেলায় ২০জন কৃষকের মাধ্যমে বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ ৪১ (অমৃত), বিএসআরআই আখ ৪৭, চায়না, সেনেগাল, ব্লাক রুবি ও ভিএমসি ৮৬-৫৫০ জাতের আখ চাষ দেওয়া হয়। প্রতিজন কৃষক ১ বিঘা হারে এ চাষ করা হয় ৪৫ বিঘা জমিতে।


শুধু তাই নয়, এ সকল চাষীরা আখ ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে আলু, গাজর ও ফরাশ সিম, বাঁধাকপি, শাক, মূলা, ফুল কপিসহ আরো কয়েকটি ফসল চাষ করেন। এতে চারা, সার, কীটনাশক ও পানি সেচসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।


উন্নয়ন বোর্ড উপকারভোগী কৃষকদের দেখাদেখি বর্তমানে লামা ও আলীকদম উপজেলার আরও প্রায় দুইশ কৃষক আখ চাষ করেছেন। এছাড়া ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদার করণ প্রকল্প’ এর আওতায় ৭ জন ও উপজেলা পরিষদের আওতায় ১০ জন চাষি আখ চাষ করেছেন।


সূত্রটি আরও জানায়, মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী প্রতি বিঘা ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষ করে নিট লাভ হিসেবে কৃষক পাচ্ছেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অপরদিকে প্রতি বিঘা তামাক চাষ করে নিট লাভ হিসেবে কৃষক পাচ্ছেন ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। লামা ও আলীকদম উপজেলায় ১ হাজার ৪৪০ টন সহ জেলার ৭টি উপজেলায় সর্বমোট ৫২ হাজার ৮০০টন আখ উৎপাদন হয়েছে বলেও জানান সূত্রটি।


এ বিষয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ এর জুনিয়র কনসালটেন্ট বসন্ত কুমার তঞ্চঙ্গা জানায়, লামা ও আলীকদম উপজেলায় ৪৫জন কৃষকের মাধ্যমে ৪৫ বিঘা জমিতে এ বছর আখ চাষ করানো হয়। ইতিমধ্যে উপকারভোগী চাষিদেরকে প্রশিক্ষণ, সার, চারা, কীটনাশক ও সেচের জন্য নগদ অর্থও প্রদান করেছি। এতে চিবিয়ে খাওয়াসহ গুড় জাতের আখ রয়েছে। এক বছর বীজ লাগালে আখ কাটার পর তা থেকে চার বছর পর্যন্ত আখ পাওয়া যায়। উদ্বুদ্ধকরণ ও এ চাষে লাভবান হওয়ায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চাষির সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।


সরেজমিন লামা পৌরসভা এলাকার কলিংগাবিল গ্রামের রাবেয়া বসরীর আখ ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সাজানো গোচালো আখ। মালিক রাবেয়া বসরি আখ ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় ১ বিঘা জমিতে রং বিলাস-৪২, বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ ৪৭, সেনেগাল ও ব্লাক রুবি জাতের এ আখ চাষ করেছেন রাবেয়া বসরি। তার ক্ষেতে প্রায় ৮ হাজার পিচ আখ রয়েছে। এতে আনুমানিক খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রতি পিচ আখ ৪০ টাকা হারে আখ বিক্রি করে তিন লাখ টাকা পাবেন।


তিনি আরও বলেন, আগে এ জমিতে তামাক চাষ করে খরচ বাদ দিয়ে ৫ হাজার টাকাও লাভ করতে পারতেন না। সাথী ফসল হিসেবে আখের ফাঁকে ফরাশসিম, মুলা, বাদাম ও গোলআলু চাষও করেছেন তিনি। এ সাথী ফসল থেকে তিনি আরও প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় করেছেন। একই কথা জানালেন, উপজেলার সরই ইউনিয়নের ক্যয়াজুপাড়ার আখ চাষি নছর উল্লাহ।


তিনি বলেন, ১ বিঘা জমিতে রং বিলাস ৪২ জাতের আখ চাষ করেছি। আখের চাহিদা থাকায় ভালো দাম পাবো বলে আশা করছি। এদিকে কলিংগাবিল পাড়ার বাসিন্দা খুচরা আখ ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানায়, প্রতি শত আখ ৪ হাজার টাকা হারে ক্রয় করে সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তিনি। অন্যদিকে আলীকদম উপজেলা সদর ইউনিয়নের ছিদ্দিক কারবারি পাড়ার চাষি আমির হোসেন জানান, আখ চাষে সব মিলিয়ে খরচ প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে আখ বিক্রি করে ১ লাখ ৮০ টাকা পেয়েছি। এতে আমার ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।


এছাড়া সবজি চাষ থেকেও ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন। একই কথা জানালেন এ উপজেলার পূর্বপালং পাড়ার চাষি আ.ন.ম তৌহিদুল ইসলাম রিয়াদ ও দুপ্পঝিরির চাষি এমরানও। দিন দিন আখ চাষ বাড়ছে বলে জানান চাষীরা।


এদিকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ এর কনসালটেন্ট কৃষিবিদ ক্যছেন বলেন, আখ অর্থকরী ফসল। এক সময় দেশে ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য আখ চাষ কমে এসেছিল, কিন্তু বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় আখ চাষের কারণে এ চাষে কৃষকদের সুদিন ফিরে আসছে। অনেক কৃষকই বর্তমানে আখ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।


তিনি আরও বলেন, বান্দরবানের প্রতিবছর গুড়ের চাহিদা ৩০ থেকে ৩২ টন কিন্তু এ জেলায় স্থানীয়ভাবে গুড় উৎপাদিত হয় শুধুমাত্র ২ থেকে ৪ টন। বাৎসরিক গুড়ের চাহিদা মেটানোর জন্য আরো ২৬ থেকে ২৮ টন প্রয়োজন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণে সুস্থ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।


ক্যছেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় তামাকের বিকল্প হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে আখ চাষ এবং পাহাড়ি আখের গুড় উৎপাদন শিল্প। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ইক্ষু জাত এবং ইক্ষু উৎপাদন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১৫০ থেকে ১৭০টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সম্প্রতি উদ্ভাবিত ইক্ষু জাত এবং ইক্ষু উৎপাদন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইক্ষুর ফলন বৃদ্ধি এবং বান্দরবানের আর্থ- সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।


২০২২-২০২৩ রোপণ মৌসুমে জেলায় ১৩০ চাষির মাধ্যমে ১৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ ও ৮০ জন প্রকৃত তামাক চাষিকে ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে।


পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বাস্তবায়নাধীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ’ একটি কার্যকরী পদক্ষেপ আখ্যা দিয়ে লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মন জানিয়েছেন, ইক্ষু থেকে নগদ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।


বান্দরবানের আবাদযোগ্য পতিত জমি এবং এক ফসলি উঁচু জমি খুব সহজেই স্বল্প সেচের মাধ্যমে আখ চাষের জন্য উপযোগী এবং অধিক সম্ভাবনাময়। বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভুক্ত কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এ জেলার কার্যক্রম আরো জোড়ালো, নিবিড়ভাবে পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি অধিদপ্তর থেকেও এরকম প্রকল্প গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।


বিবার্তা/আরমান/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com