রোহিঙ্গা নির্যাতনের ৬ বছর
গণহত্যা দিবসে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার আকুতি
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৭:০৬
গণহত্যা দিবসে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার আকুতি
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের ৬ বছর আজ। এই দিনটিকে রোহিঙ্গারা কালো দিবস আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। এ উপলক্ষ্যে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘হোপ ইজ হোম’ ক্যাম্পেইন পালন করেছেন রোহিঙ্গারা।


সরেজমিনে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ‘হোপ ইজ হোম’ ক্যাম্পেইন উপলক্ষ্যে আশপাশের ক্যাম্প থেকে লোকজন খেলার মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন। ক্যাম্পেইন সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরাও যোগ দেন। এসময় পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলেন।


রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছরে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শোয়াইব, মাস্টার নুরুল আমিন, মাস্টার জুবায়ের, মোহাম্মদ ইউসুফ ও মাস্টার কামাল প্রমুখ।


সমাবেশে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। আমরা এই গণহত্যা দিবসে পালন করছি কারণ এদিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার আমাদের ওপর জাতিগত গণহত্যা চালিয়েছে। এই দেশে আর কত বছর থাকব। আর থাকতে চাই না। আমরা স্বদেশে ফিরতে চাই।


সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী সৈয়দউল্লাহ বলেন, মিয়ানমার আমাদের দেশ, অনতিবিলম্বে আমাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে প্রত্যাবাসন সফল করতে দেশটির পাশে থাকতে হবে।


২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলের মংডু, বুচিদং ও রাসেথং জেলার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। সেসময় প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। ওই দিনটিকে স্মরণে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ‘রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে’ পালন করে আসছে।


জানা গেছে, রোহিঙ্গা গণহত্যার ৬ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা দিবসটি পালন করেন। তারা সেখানে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার, দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন।


দাবিগুলো হলো- মিয়ানমারে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, সীমিত সময় রাখা যাবে মিয়ানমার ট্রানজিট ক্যাম্পে, সকল রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিজস্ব সহায়-সম্বল ফেরত, প্রত্যাবাসনের সময় বেঁধে দেওয়া, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, একসঙ্গে গ্রামের সব মানুষকে প্রত্যাবাসন করা ও রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থাপন না করা। এছাড়া প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ও বাংলাদেশসহ দাতা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা।


৮ আমর্ড পুলিশের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর (বিপিএম) বলেন, আজ রোহিঙ্গাদের গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে তারা একটি সমাবেশ করেছে। তাদের এই সমাবেশ ঘিরে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।


বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর


মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগেও কয়েক দফায় আসা রোহিঙ্গা মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন সাড়ে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাস।


২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও বাড়িঘর পুড়িয়ে রাজ্যজুড়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি করেছিল মিয়ানমার বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এসব রোহিঙ্গা। পরে তাদের ঠাঁই হয় উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ের ৩১টি ক্যাম্পে।


এদিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরে তাদের প্রত্যাবাসনের কয়েক দফা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমারের টালবাহানা ও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শর্ত-অজুহাতে বার বার আটকে যায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। ২০১৮ সালে প্রত্যাবাসনের নির্ধারিত দিনে সব ধরনের প্রস্তুতির পরও তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা হঠাৎ মত পাল্টালে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরের বছর ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় উদ্যোগও বিভিন্ন অজুহাতে ভেস্তে গেছে। তখন রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছিল।


৬ বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ২০টি মামলা, তবুও থামছে না অপরাধ


২৫ আগষ্ট ২০১৭ সাল। দেশের দক্ষিণ সীমান্ত উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেয় ৭ লাখের অধিক বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস ৬ বছরে পা দিবে। আর এই ৬ বছরে সবমিলিয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখ। এই ৬ বছরের আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আলোচিত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে এরা।


আজকের তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, গেল ৬ বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২৩৮টি অস্ত্র মামলা, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার মামলা, ৪৪টি অপহরণ মামলা, ২৪৩টি হত্যামামলা, ৩৭টি মানবপাচার মামলা, ৬২টি ডাকাতির মামলা, ৪২টি ফরেনার্স এক্ট মামলা, ৬৫টি বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা এবং সর্বোচ্চ ২০৫৭টি মাদক মামলা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া গত ৬ বছরে রোহিঙ্গাদের দ্বারা পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে এমন ৭ মামলায় ৭৭জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে।


যেখানে সর্বমোট ৩০২০টি মামলায় এই পর্যন্ত ৬৮৩৭ রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন ঘটনায় রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম।


এই ব্যাপারে কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর এড ফরিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে এমন কোনো অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করে না। রীতিমতো স্থানীয়দের টার্গেট কিলার হিসেবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান জেলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। প্রত্যাবাসন যতই বিলম্বিত হচ্ছে ততই বাড়ছে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ঝুকি এমনই বলছেন বিশ্লেষকেরা।


বিবার্তা/ফরহাদ/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com