কক্সবাজারের ঘরছাড়া দুই তরুণ জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ত
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১৯:২০
কক্সবাজারের ঘরছাড়া দুই তরুণ জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ত
কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

সিলেটের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধায় থেকে জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ ১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এর মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামের বাসিন্দা হামিদুল হকের ছেলে সাদমান আরেফিন ফাহিম (২১) ও মধ্যম মেরংলোয়া গ্রামের শিক্ষক মোহাম্মদ এনামুল হকের ছেলে মো. ইরতেজা হাসনাত লাবিব (১৯)।


এর আগে ২০ দিন নিখোঁজ থাকার পর এই দুজনকে মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) গ্রেফতারের পর তারা নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’য় জড়িয়ে পড়ার খবর জানাজানি হয়।


উভয়ের স্বজনরা জানিয়েছেন, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পর থেকে তাদের মধ্যে একা থাকার প্রবণতা ছিল। চরমপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত হওয়ার কোন আলামত ধরা না পড়লেও বাড়িতে পুরোটা সময়জুড়ে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকতো তারা।


পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত দুজনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা গত ২৬ জুলাই দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ ছিলেন। দুজনই কক্সবাজারের দুটি কলেজের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ফাহিম কক্সবাজার সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগে অধ্যয়নরত। পড়াশোনার পাশাপাশি শহরে ‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ নাম একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো সে। অপরদিকে লাবিব কক্সবাজার সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এ বছর এইচএসসিতে অংশ নেয়ার কথা ছিল তার।


এদিকে তাদের গ্রেফতারের পর গত বুধবার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, গ্রেফতাকৃতরা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য। তাদের বিশ্বাস, ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেয়া হবে।


অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায় যে, ঘরছাড়া সবাই কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন।


এদিকে গ্রেফতার দুজনসহ আরো ১৫ জনকে গত বুধবার থেকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় আদালতে হাজির করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। একইসঙ্গে ১৫ আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শাহজাদা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন।


জানা গেছে, ‘পাঠাও’ এর ডেলিভারি ম্যান ফাহিম রামু চৌমুহনীর থেকে মিনিট দশেকের পথ দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামে। কয়েক বছর পূর্বে ভারুয়াখালীর পশ্চিমপাড়া থেকে এসে থিতু হয়েছিলেন সৌদি প্রবাসী হামিদুল হক। ২১ বছর সৌদি আরবে কাটিয়ে ২০১৪ সালের মার্চে দেশে আসেন তিনি। বিয়েও করেন ছিকলঘাট থেকে। সুতোর ব্যবসা দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার।


গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বেলা ১২টা। আশেপাশে মানুষের কোলাহল থাকলেও ফাহিমদের বাড়িতে সুনসান নীরবতা। বড় ছেলে ফাহিম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় লজ্জিত হামিদুল হক। ছেলে ঠিক কবে থেকে এ কাজে জড়িয়ে গেছেন টের পাননি তিনি।


আলাপকালে হামিদুল হক বলেন, ফাহিম রামু খিজারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর ভর্তি হয় রামু কলেজে। তবে আমাদের ইচ্ছেতে পরের বছর ভর্তি হয় কক্সবাজার শহরের একটি কলেজে।


স্বজনরা জানিয়েছেন, ফাহিম কলেজে ভর্তির পর পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিল। সারাদিন বাসায় বসে থাকতো। পরে তাকে ব্যস্ত রাখতে চাকরি করতে বলে পরিবারের সদস্যরা।


এরই প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ মাসে ৩ হাজার টাকা বেতন ও পণ্য ডেলিভারির কমিশনের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের খুরুশকুল রাস্তার মাথাস্থ ‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ নামক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয় ফাহিম। সেখান থেকে ২৫ জুলাই বাড়িতে যায়, পরদিন ২৬ জুলাই থেকে নিখোঁজ হন।


জানতে চাইলে ‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ কক্সবাজার অফিসের কর্মকর্তা রানা দাশ বলেন, ফাহিমের ঘনিষ্ঠজন ইমরান থেকে একবার খোঁজ নিই, পরে আর নিইনি।


ফাহিমের চলাফেরায় কোনো পরিবর্তন দেখেছেন কিনা এমন প্রশ্নে রানা দাশ বলেন, কর্মচরীরা অফিসে আসবে, কাজ করবে, হিসাব দেবে এটুকু। এরই বাইরে কারো ব্যক্তিগত বিষয়কে গুরুত্ব দিইনি।


ফাহিম নিখোঁজের পর থানায় কিংবা প্রশাসনের কাউকে অবহিত করেননি হামিদুল হক। তবে তিনদিন পর স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান মামা জাফর আলম।


জানতে চাইলে ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, ফাহিমের মামা জাফর আলম আমার ঘনিষ্ঠজন। সে আমাকে জানায় যে, ফাহিমকে পড়াশোনায় চাপ দেয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে বুধবার গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি জেনেছি।


মা হাসিনা বেগমের ধারণা, তার ছেলেকে কেউ মগজধোলাই করে বিপথগামী করেছে। লাবিবের দায় নেবে না শিক্ষক পিতা-মাতা।


হাসিনা বলেন, আমার টুইন বেবি ছিল। আমি যখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন পেটে আমার একটা বেবি মারা যায়। এর একমাস পর জন্ম হয় লাবিবের। অনেক কষ্ট করে ছেলেটা জন্ম দিয়েছি, মানুষ করছি। এখন ভেবে নিয়েছি, আমার একটা ছেলে পেটে মারা গেছে, আরেকটি ছেলে মরে গেছে। এখানে শেষ! কোনো জঙ্গি ছেলের দায় নেব না।


হতাশা-ক্ষোভে বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন গ্রেফতার ইরতেজা হাসনাত লাবিবের মা স্কুল শিক্ষিকা নাছিমা খানম।


তিনি বলেন, এখন রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে। জঙ্গি ছেলের অপরাধের দায় আমরা নেব না। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ।


লাবিবের বাবা মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ২৬ জুলাই সকালে আমি ও তার মা স্কুলে যাই। বিকেল পাঁচটায় বাসায় ফিরে দেখি কলেজে যাওয়ার ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেছে লাবিব। মোবাইলও বন্ধ ছিল।


এনামুল হক বলেন, পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চাপ দিলে এর আগেও ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল লাবিব। কিন্তু দুদিন পর ফিরে এসেছিল। তাই তাৎক্ষণিক নিখোঁজের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। এছাড়া ১৭ তারিখ এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। আমি এডমিট কার্ডের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। এবং সিদ্ধান্ত নিই, ১৭ আগস্ট না এলে প্রশাসনকে জানাবো। এর মধ্যে বুধবার খবর আসে, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে মৌলভীবাজারে গ্রেফতার হয়েছে লাবিব।


লাবিবের মা নাছিমা খানম বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একদম পড়াশোনা করতো না। আচরণেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। সারাদিন বাসায় রুমে বসে মোবাইলে গেম খেলতো। ঝগড়া করে একটি মোবাইল ভেঙে ফেলে। লাবিব বলতো, আমাকে সহ্য করতে না পারলে ত্যাজ্য করে দাও।


এনামুল হক বলেন, লাবিব মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিল। তাকে সাইকোলজিস্ট দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে সুযোগ হলো না। এ দায় আমার। হয়তো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে উগ্রপন্থীরা।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রামু থানার দুজন শিক্ষার্থী জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পেরেছি। তাদের এলাকাগুলোতে তৎপরতা শুরু করেছে পুলিশ। যেখানে তাদের চলাচল বেশি ছিল, সেসব এলাকায় পুলিশ তৎপরতা চলছে। পাশাপাশি দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরদারি বাড়ানো হবে। একই সাথে কারা কারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেসব ব্যক্তির ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।


বিবার্তা/ফরহাদ/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com