শিরোনাম
নাইজেরিয়ার পতাকা মানব
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:৫৭
নাইজেরিয়ার পতাকা মানব
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৫৯ সালের কথা। নাইজেরিয়ার তরুণ মাইকেল তাইভু আকিনকুনমি-র বয়স তখন ২৩ বছর। লন্ডনের নরউড টেকনিক্যাল কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। একদিন তাঁর চোখ পড়লো পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনে। নাইজেরিয়ার জাতীয় পতাকার ডিজাইন প্রতিযোগিতা।


আকিনকুনমি তা দেখে ভাবতে বসে গেলেন, কেমন হতে পারে নিজ দেশের জাতীয় পতাকা! ভাবতে-ভাবতে সাদা আর সবুজ মিশিয়ে একটি ডিজাইন করে ফেললেন আর সেটি পাঠিয়ে দিলেন লাগোসে। একটু দেরিই হয়ে গেল। তা হোক, ওসব নিয়ে ভাবনা নেই আকিনকুনমির।


তারপর সব ভুলে লেখাপড়ায় মগ্ন হয়ে গেলেন আকিনকুনমি। ওই বছর অক্টোবরে তাঁর ডাক এলো যুক্তরাজ্যে নাইজেরিয়ান হাই কমিশনের লন্ডন অফিস থেকে। আকিনকুনমি সেখানে গেলে তাঁকে জানানো হলো, অনেক ডিজাইনের মধ্য থেকে তাঁরটিই মনোনীত হয়েছে। পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে দেয়া হলো ১০০ পাউন্ড (১৯৫৯ সালে যা ২৮১ মার্কিন ডলার)। শুধু কি ১০০ পাউন্ডই? না, এর সাথে নাইজেরিয়ার ইতিহাসের পাতায় তাঁর জন্যে একটি স্থানও চিরকালের মতো বরাদ্দ হয়ে গেল।


এসব হচ্ছে ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসের অর্থাৎ নাইজেরিয়ার স্বাধীনতা লাভের ঠিক এক বছর আগের কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরও ৬২ বছর আগে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক ''নাইজেরিয়া'' নামটি প্রস্তাব করেন।


তারপর তো দেশ স্বাধীন হলো। লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেন আকিনকুনমি। এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। থাকেন ইবাদান এলাকার অপেক্ষাকৃত গরীব একটি এলাকায়; সাদা-সবুজ রঙের একটি বাড়িতে। স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আজ বছরবিশেক হলো। সঙ্গী বলতে ২৮ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে।


আকিনকুনমি যে-বাড়িতে থাকেন, সেখানে গাড়ি যাওয়ার কোনো পথ নেই, যেতে হলে হেঁটেই যেতে হবে। তাঁর কোনো টেলিফোন নেই। তবে ১৯৯০ সালের দিকে কেনা একটি গাড়ি আছে। সেটিতেও খুব-একটা চড়েন না আকিনকুনমি। পুরো এলাকাটা পায়ে হেঁটে বেড়ান। কাছেই স্কুলজীবনের দুই বন্ধু আছেন, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন। রঙহীন, নিস্তরঙ্গ দৈনন্দিন জীবনে বিনোদন বলতে তাঁর এটুকুই।


আর বেড়ানো? সর্বশেষ ভ্রমণ তাঁর ২০১৪ সালে। সেবার তিনি গিয়েছিলেন দেশের রাজধানী আবুজায় আর সেখানে তাঁকে জাতীয় সম্মাননা প্রদান করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথন। সেসময় তাঁকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী হিসেবে সারা জীবনের পুরো বেতনও দেয়া হয়, যার পরিমাণ আট লাখ নাইরা (মোটামুটি চার হাজার মার্কিন ডলার)। এ টাকাটাই প্রতি মাসে ভেঙে ভেঙে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে।


তবে পুরনো দিনের এসব স্মৃতি খুব-একটা মনে করতে পারেন না আকিনকুনমি। ওই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জনাথন তাঁকে কী বলেছিলেন, তাও মনে করতে পারেন না তিনি। যেমন দুই পুরনো বন্ধুর নাম মনে করতেও অনেক কষ্ট হয় তাঁর।


তা এখন বয়স কত চলছে আপনার? জানতে চাইলে আকিনকুনমি জবাব দেন - ৭৫। তবে ছেলে ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তাও মেনে নেন। বলেন, ৭৯।


আকিনকুনমির ছেলে অবশ্য জোর দিয়ে বলেন যে তাঁর বাবার স্মরণশক্তি বেশ ভালোই আছে, কিন্তু নানা প্রশ্ন করে দেখা যায় যে আকিনকুনমি নিজ জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথাই এখন মনে করতে পারেন না। যেমন জাতীয় পতাকার ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় আকিনকুনমির দেহে একটা অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু কেন সেটা, তা-ই বেমালুম ভুলে গেছেন আকিনকুনমি। তাঁর মনে নেই ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবরের অনুভূতির কথাও, যেদিন নাইজেরিয়া প্রথমবারের মতো তার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। পতাকার রূপকার হিসেবে আকিনকুনমির তো উদ্বেলিত হওয়ার এবং আমৃত্যু সেই স্মৃতি মনে থাকার কথা। কিন্তু নাহ, তেমন মনেই করতে পারলেন না তিনি। শুধু বললেন, ''ও হ্যাঁ। আমার ভালোই লেগেছিল।


মজার ব্যাপার হলো, শুধু আকিনকুনমিই সবকিছু ভুলে গেছেন তা নয়, একসময় তাঁকেও সবাই ভুলে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল, আকিনকুনমি নামের মানুষটি বেঁচে নেই। এই বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে তাঁকে বর্তমানের আলোয় টেনে নিয়ে আসেন সানডে ওলাওয়ালে ওলানিরান নামে এক গবেষক।


ওলানিরান তখন ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। সেটা ২০০৬ সালের কথা। নাইজেরিয়ার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন জাতীয় পতাকার ডিজাইনার আকিনকুনমির নাম। তখনই ঠিক করে ফেলেন, মানুষটিকে খুঁজে বের করবেন। দেখবেন, কোথায় আছেন, কেমন আছেন ''হিরো উইথআউট অনার''।.


খুঁজতে গিয়ে পথে নেমেই বিপাক কাকে বলে টের পেতে থাকলেন ওলানিরান। যাকেই জিজ্ঞেস করেন, জবাব আসে, ''ও, ঊনি তো মারা গেছেন! তাঁকে খুঁজে লাভ নেই, বাদ দেন তো! শুধু পতাকা নিয়েই লিখুন।''


এসব শুনে একটু হতাশও লাগে ওলানিরানের। কিন্তু তিনি তো গবেষক। আকিনকুনমি যে মারা গেছেন, সেটাও তো তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে। তিনি হাল ছাড়েন না, খোঁজাখুঁজি চালিয়েই যান। এবং অবশেষে ইবাদানে তাঁকে পেয়েই যান।


আকিনকুনমির বাসস্থানে গিয়ে ওলানিরান যা দেখেন তাতে তাঁর চোখের পানি বাধ মানে না। তিনি দেখেন এক নিঃসঙ্গ বুড়ো মানুষ, আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলেই চলেছেন। তাঁকে দেখার কেউ নেই। ওলানিরান ঠিক করলেন, দেশের ইতিহাসের অংশ এই মানুষটির কথা দেশবাসীকে জানাতে হবে। ''সান'' পত্রিকার এক সাংবাদিককে জানালেন আকিনকুনমির কথা। সাংবাদিক তো অবাক, আকিনকুনমি বেঁচে আছেন!


স্বাধীনতা দিবসের দু'দিন আগে আবার আকিনকুনমির বাসস্থানে গেলেন দু'জন। তারা অবাক হলেন দেশপ্রেমে ভরপুর মানুষটির কথা শুনে। নিজের এমন দুরবস্থার মধ্যেও তনি বলে চলেছেন, 'ঈশ্বর নাইজেরিয়ার মঙ্গল করুন' 'নাইজেরিয়া এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে'।


২০০৬ সালের ১ অক্টোবর নাইজেরিয়ার স্বাধীনতা দিবসে ''সান'' পত্রিকায় বেরুলো আকিনকুনমির করুণ জীবনের কাহিনী। দেশবাসী জানলো, সাবেক সরকারি কর্মচারী হিসেবে আকিনকুনমি পেনশন পান বটে, তবে তা এতোই অনিয়মিত যে তা দিয়ে তার প্রতিদিনের খাবার জোটানোই মুশকিল। আশপাশের লোকজনের কেউ-কেউ তাঁকে দেখতে যেত, খাবারদাবার ও কাপড়চোপড় দিত।


২০০৮ সালে ওলানারিয়ান যোগাযোগ করলেন টিভি শো ''হু ওয়ান্টস টু বি অ্যা মিলিয়নেয়ার''-এর নাইজেরিয়ান এডিশনের কর্মকর্তাদের সাথে। তারা এবার আকিনকুনমিকে হাজির করলো তাদের শো'র একটি বিশেষ পর্বে, আর উপস্থিতির সম্মানী হিসেবে তাঁকে দিল ২০ লাখ নাইরার (১০ হাজার মার্কিন ডলার) একটি চেক। ছেলেকে নিয়ে এখন যে সাদা-সবুজ রঙের বাড়িতে থাকেন আকিনকুনমি, ওই টাকাতেই বাড়িটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।


ওলানারিয়ান ও তার সমমনা আরো অনেকে এখানেই থেমে থাকলেন না। তারা আকিনকুনমির বিষয়ে সরকারের কাছে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকলেন। তাতে কাজও হলো। একদিন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ডোরা আকুনইলি চলে এলেন আকিনকুনমির ডেরায়। সম্ভবত তারই চেষ্টায় পরে ''৫০ বিশিষ্ট নাইজেরিয়ান'' সম্মাননাপ্রাপ্তদের একজন হলেন তিনি।


২০১০ সালের অক্টোবরে নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে নাইজেরিয়ার বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সম্মাননা পেলেন আকিনকুনমি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ওটাই তাঁর প্রথম সম্মাননা লাভ।


এসব সম্মান ও সম্মাননার কথা আজকাল মনেই রাখতে পারেন না আকিনকুনমি। তবে একটা ঘটনা তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজলে হয়ে আছে। ঔপনিবেসিক ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে সেখানে তাঁরই ডিজাইন করা সাদা-সবুজ জাতীয় পতাকা তোলার পর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে বিপুল সম্মান পেয়েছিলেন, সেকথা ভুলতে পারেন না আকিনকুনমি। বলেন, সবাই আমাকে চিনতে শুরু করলো আর ডাকতে লাগলো ''মিস্টার ফ্ল্যাগ ম্যান'' বলে। সূত্র : আল জাজিরা


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com