শিরোনাম
উত্তর কোরিয়ার এক হোটেলের রহস্যময় পাঁচতলা
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০১৮, ১৮:৫৬
উত্তর কোরিয়ার এক হোটেলের রহস্যময় পাঁচতলা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ওটো ভার্মবিয়েরের কাহিনি মনে আছে? উত্তর কোরিয়ায় বেড়াতে যাওয়া এই আমেরিকান ছাত্রকে পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলের পাঁচতলায় যাবার ''অপরাধে'' আটক করা হয়েছিল এবং তারপরেই ওই ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল।


মার্কিন ডাক্তার কেলভিন সান এখানে স্মৃতিচারণ করছেন সেই একই হোটেলের এক গোপন অংশে তার রাত কাটানোর কাহিনী। একইসাথে তিনি অন্য পর্যটকদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে তারা যেন ওই হোটেল থেকে দূরে থাকেন।


কেলভিন সান ও তার সঙ্গীদের সেই রাতেই উত্তর কোরিয়া ছেড়ে যাবার কথা ছিল। তিনি ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে নির্ঘুম ছিলেন। তিনি ও তার বন্ধুরা একটা মিনিবাসে উঠলেন পিয়ংইয়ং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাবার জন্য। এমন সময় মিনিবাসটিতে উঠলো উত্তর কোরিয়ান রক্ষীদের একটি দল। তারা বললেন, ''একটা সমস্যা হয়েছে। সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের যেতে দেয়া হবে না।''


বাসের মধ্যে একটা নিরবতা নেমে এলো। সান ভাবছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন দেশে তার গত একটি সপ্তাহ ঘুরে বেড়ানোর কথা। এটি ছিল তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভ্রমণগুলোর একটি।সান বলেন, "উত্তর কোরিয়ায় ওই এক সপ্তাহে আমরা এত কিছু করেছিলাম যে আমাদের মনেই হয়নি ওই হোটেলের পাঁচ তলায় যাওয়াটা কোনো সমস্যার কারণ হতে পারে।''


রক্ষীরা পর্যটক দলটিকে মিনিবাস থেকে নেমে আসতে বললো। তখনও সানের ওই ব্যাপারটার (হোটেলের পাঁচ তলায় যাওয়া) কথা মনে হয়নি।


পেছন ফিরে দেখা


কেলভিন সানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিউইয়র্ক শহরে। তার বাবা-মা চীনা। তার বয়স কুড়ির কোঠায় পৌঁছানোর আগে তিনি ওই রাজ্য ছেড়ে বলতে গেলে বের হননি। তিনি তখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েটের ছাত্র, যার ক্যাম্পাস নিউইয়র্কের বাড়ি থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। তাকে তার পরিচিত গন্ডির বাইরে বের হতে হয়নি।


কিন্তু ২০১০ সালে তিনি মিশরে বেড়াতে গেলেন, আর সেই থেকেই তার পৃথিবী ঘুরে দেখার সাধ জেগে উঠলো। প্রতিটি ছুটি এবং শনি-রবিবারগুলোকেও তিনি কোনো-না-কোনো নতুন দেশে যাবার কাজে ব্যবহার করতে লাগলেন।


মেডিক্যাল স্কুলে দ্বিতীয় বর্ষ শুরুর আগেই সান ঠিক করলেন, গ্রীষ্মের ছুটিকে তিনি এমন একটা ভ্রমণে বের হবেন, যা শুরু হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশ থেকে এবং শেষ হবে এশিয়ার কোনো এক জায়গায়।


তিনি যে ভ্রমণসূচি তৈরি করলেন, তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা। উত্তর কোরিয়া তার এ পরিকল্পনার অংশ ছিল না। পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলের গোপন পাঁচতলা তো ঘুণাক্ষরেও ছিল না।


সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখনকার দিনে পশ্চিমা পর্যটকরা উত্তর কোরিয়া যেতে চাইলে একজন প্রাইভেট ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিতে হতো। সে সময় পাঁচ-ছ'টি আন্তর্জাতিক ট্যুর অপারেটর ছিল, যারা চীন হয়ে উত্তর কোরিয়ায় গাইডেড ট্যুর করাতো। ২০১৭ সালে এই ধরনের ভ্রমণের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়। অনেকের মতে, এর একটা কারণ ছিল, একজন পশ্চিমা ছাত্র এভাবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে ইয়াংগাকো হোটেলের সেই নিষিদ্ধ পঞ্চম তলায় গিয়েছিলেন।


পেইচিং থাকার সময় কেলভিন সান দেখলেন, আমেরিকায় ফিরে যাবার আগে তার হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে। তিনি ভাবলেন, উত্তর কোরিয়ায় যাওয়ার এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ। তিনি ট্যুর অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং যে সবচেয়ে ভালো অফার দিলো তাকে বেছে নিলেন।


নিউইয়র্কে ফিরে যাবার আগে সে দফায় উত্তর কোরিয়াই ছিল শেষ দেশ। এর পরই তার মেডিক্যাল স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশোনায় ফিরে যাবার কথা।


সান ছিলেন ২০ জনের একটি গ্রুপের অংশ। এতে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান এবং চীনা পর্যটকরা ছিলেন - যাদের অধিকাংশের বয়েসই ছিল ২০-এর কোঠায়।


ঠিক হলো, উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংএ তারা থাকবেন ইয়াংগাকডো হোটেলে। তবে এর পাঁচতলার ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।


উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পা রেখে যা দেখলেন, তার বয়ান তিনি দিয়েছেন এভাবে - "শহরের ভবন, পোস্টার, রাস্তার নির্দেশিকা, লোকজনের কাপড়-চোপড় - সবই যেন শুধু সাদা, ধূসর বা কালো। তার মাঝে একটু হয়তো লাল আছে - কারণ তা কমিউনিস্ট পার্টির রঙ। মনে হচ্ছিল যেন আমি একটা টাইম মেশিনে বসে ১৯৭০এর দশকের সোভিয়েট টিভির অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছি।"


সান এবং তার দলকে উত্তর কোরিয়া ঘুরে দেখানোর দায়িত্বে ছিলেন দুজন পুরুষ ওএকজন নারী গাইড। তাদের বয়েস ছিল ৪০-এর কোঠায়। দু'জনই এক সময় সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। সান বলেন, "শুরুতে তাদের মনে হয়েছিল একটু কড়া। তারা বলছিল, তাদের সাহায্য ছাড়া রাস্তার পার না হতে, বা কিছু-কিছু ভবনের ছবি না তুলতে। কিন্তু একটু পরই আমাদের সাথে তাদের বেশ ভাব হয়ে গেল।"


সান বলেন,"গাইডরা মদ পান করতে ভালোবাসতেন। আমরা জানতে পারলাম যে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে মদের একটা কেন্দ্রীয় ভুমিকা আছে, এবং তারা প্রতি সন্ধ্যাতেই তাদের সাথে আড্ডা-গল্পগুজব করতে আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন।"


তারা উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ঘুরলেন। তবে উত্তর কোরিয়া কী চোখে আমেরিকাকে দেখে সেটির আসল ধারণা সান পেয়েছিলেন সেই সব মদ পান এবং সামাজিক মেলামেশার সময়। সান বলেন, "আমাদের গাইডরা মাইকেল জ্যাকসনের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। তারা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিনা। তারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্মমতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিল। উত্তর কোরিয়ায় যে অল্প কিছু আন্তর্জাতিক টিভি অনুষ্ঠান দেখানো হতো তার একটি ছিল আমেরিকান রিয়ালিটি শো 'কপস' যাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুসরণ করে তার বাস্তব অভিযান দেখানো হয়। এটি নিয়েও তারা অনেক প্রশ্ন করতো।"


কিন্তু তাদের প্রশ্নের বিষয়বস্তু নয়, বরং যেভাবে তারা প্রশ্নগুলো করতো, সেটাই সানকে চমৎকৃত করতো। মনে হতো এটা নিতান্ত কৌতুহলের চাইতেও বেশি কিছু। যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মনে যে বিশেষ ধারণা রয়েছে, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা।


কয়েকদিন পার হবার পর নিয়মকানুন নিয়ে গাইডদের কড়াকড়ি কমে গেল। এর পর গ্রুপের কেউ একা-একা রাস্তা পার হলে তারা আর উদ্বিগ্ন হতেন না। ছবি না তোলার জন্য নির্দেশও আর দিতেন না তারা। গাইডদের সাথেও সম্পর্ক সহজ হয়ে এলো তাদের। উত্তর কোরিয়ায় তাদের শেষ রাতে পুরো গ্রুপটি সবাই মিলে ডিপ্লো নামে একটা নাইটক্লাবে গেলেন।


ইয়াংগাকডো হোটেলে ফিরে গাইডরা আরো এক দফা মদ পানের জন্য গ্রুপটিকে আমন্ত্রণ জানালেন। এর পর গ্রুপটির সদস্যরা যে যার রুমের দিকে রওনা দিলেন। কিন্তু কয়েকজন, যারা অতটা ক্লান্ত হননি, তারা ভাবলেন, ঘুমোতে যাবার আগে একটা ঘরে সবাই মিলে আবার একটা আড্ডা হোক।


তখনই আরেকজন প্রস্তাব করলেন, হোটেলটার বাকি অংশগুলো ঘুরে দেখলে কেমন হয়?


উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলোর একটি হচ্ছে ৪৭-তলা এই ইয়াংগাকডো হোটেল। তায়েডং নদীর মাঝখানে একটি দ্বীপের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই হোটেল। এতে আছে চারটি রেস্তোরাঁ, বোলিং এবং ম্যাসাজ পার্লার। বেডরুমগুলোতে টিভি আছে তাতে পুরোনো বিবিসির ওয়ার্ল্ড নিউজ বার বার দেখানো হয়।


এ দেশে আসা টুরিস্টদের কাছে এটাই সবচেয়ে পছন্দের থাকার জায়গা। উত্তর কোরিয়ার টুরিস্ট বোর্ড একে পাঁচতারা হোটেল হিসেবে প্রচার করে, কিন্তু ইন্টারনেটে পর্যটকদের মূল্যায়নে একে তিন-তারার কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়।


একজন ব্লগার এমন বর্ণনাই করেছেন, "দেখে মনে হতে পারে যেন তারা ১৯৮৪ সালে ভেগাসে কাউকে পাঠিয়েছিল, বলা হয়েছিল, ওখানে গিয়ে দেখে এসো কী কী আছে, তার পর হুবহু সেরকম একটা হোটেল বানিয়ে ফেলো। তারা সেটাই করেছে, কিন্তু তা করতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে।''


এমন একটি হোটেলে পাঁচ রাত থাকার সময় সান এবং তার সফরসঙ্গীদের সাথে সর্বক্ষণ ছিল গাইডরা। তাদের ছাড়া নিজেরা নিজেরা ভবনটি ঘুরে দেখার এটাই সুযোগ। তাছাড়া এমন কথা তো বলা হয়নি যে হোটেলটা ঘুরে দেখা যাবে না।


অতএব তারা প্রথমে উঠলেন খোলা ছাদে। তারপর গেলেন একেবারে ওপরের তলায় ঘুর্ণায়মান রেস্তোরাঁতে। তার পর লিফট দিয়ে নিচে নামতে লাগলেন। তখনই গ্রুপের একজন খেয়াল করলেন যে লিফটে পাঁচ তলায় যাবার কোনো বোতাম নেই। লিফটের প্যানেলে দেখা যাচ্ছে চারতলা, তার পরই পাঁচ বাদ দিয়ে ছয় তলা।


একজন বললেন, "আমাদের দেখা উচিত এর কোনো পাঁচ তলা আসলেই আছে কিনা। নাকি তারা কোনো কুসংস্কারের কারণে ইচ্ছা করেই লিফটে পাঁচতলা বলে কিছু রাখেনি।''


ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগাররা এই হোটেলের গোপন পাঁচতলায় কি আছে তা নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক জল্পনা কল্পনা করেছেন। সানের গ্রুপে কয়েকজন ছিলেন যারা অভিজ্ঞ পর্যটক, তারা এটার কথা শুনেছিলেন। সান এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।


তিনি বলেন, "ইয়াংগাকডো হোটেলের পাঁচ তলায় গেছি এমন প্রথম লোক আমরা ছিলাম না, শেষও ছিলাম না। ২০১১ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় কোনো পর্যটককে কখনো আটক করা হয় নি। আমরা যা করছিলাম তা কতটা গুরুতর তার কো্নো ধারণা আমাদের ছিল না।"


সান বলেন, "আমাদের কখনোই পঞ্চম তলা থেকে দূরে থাকতে বলেনি আমাদের গাইডরা। অন্য একজন পর্যটক যিনি এর আগেও সেখানে গেছেন, তিনি জানিয়েছিলেন যে পঞ্চম তলার যেহেতু টেকনিক্যালি কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই সেখানে গেলে তাদের কোনো অসুবিধে হবে না।''


ফলে সান-রা চারতলায় পৌঁছে লিফট থেকে বেরিয়ে এলেন এবং হোটেলের পেছনের অংশের সিঁড়ির দিকে গেলেন। তারা হাসিখুশিই ছিলেন, তবে তাদের ভেতরে একটা উত্তেজনাও কাজ করছিল।


"আমাদের একজন করিডোরে আমাদের আগে আগে হাঁটছিল। সে হঠাৎ ঘুরে দৌড়ে এলো। বললো, 'না, এদিকে নয়, আমি একটা চিৎকার শুনতে পেয়েছি।'


সান কোনো চিৎকার শুনতে পাননি, কিন্তু তার ভয়-ভয় লাগছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, দিক পরিবর্তন করে ছয় তলায় যাবন, তার পর সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় নামবেন।


এই পথ দিয়ে পাঁচ তলায় ঢুকতে গিয়ে তারা দেখলেন সেখানে কোন পাহারা নেই, এবং পথটা খোলা। তারা যার যার ক্যামেরা বের করলেন, এবং ভেতরে ঢুকলেন।


প্রথম যেটা তাদের চোখে পড়লো যে সেই ফ্লোরের ছাদ খুব নিচু, অন্য তলাগুলোর তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তাদের কয়েকজনকে মাথা কাত করে বা নিচু করে চলতে হচ্ছিল। তারা একেকজন গেলেন একেক দিকে।


হাঁটতে হাঁটতে সান লক্ষ্য করলেন যে পুরো জায়গাটায় আলো খুব কম, কংক্রিটের বাংকারের মতো। নিচু সিলিং ছাড়া বাকিটা দেখতে একটা সাধারণ হোটেলের করিডোরের মতোই, দু'পাশে দরজা। বেশিরভাগ দরজাই বন্ধ, তবে একটি কক্ষ খোলা। দরজার বাইরে একজোড়া জুতো পড়ে আছে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তারা।


"ঘরটার ভেতর থেকে আলো আসছিল। আমরা সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখতে পেলাম। কিছু টিভি পর্দা আছে, তাতে বিভিন্ন বেডরুমের ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে যা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয় বলে মনে হলো। আমি ভাবলাম, হোটেলের কর্মীরা অতিথিদের ওপর নজরদারি করার যে কথা শোনা গেছে তার যন্ত্রপাতি এখানেই রাখা হয়।"


সানের একজন বন্ধু জায়গাটির একটা ভিডিও করতে শুরু করলেন। সান ছবি তুলতে লাগলেন। সবাই কথা বলছিলেন ফিস ফিস করে।


তারা ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফিও ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাদের খুঁজে বের করতে কেউ আসেনি।


ঘরগুলোর দেয়ালে উজ্জ্বল রঙে আঁকা আমেরিকা ও জাপা্নবিরোধী প্রচারণামূলক ছবি ঝোলানো ছিল। কোনো কোনোটিতে ছিল সাবেক শীর্ষ নেতা কিম জং ইলের ছবি। একটি ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে: "এই বোমা আমেরিকানদের তৈরি। আমেরিকানদের তৈরি যে কোনো জিনিসই আমাদের শত্রু। আমেরিকার বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বার প্রতিশোধ নাও।"


কয়েক মিনিট পরেই একজন অপরিচিত লোক ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে।


"পথ হারিয়েছো?" সে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো ইংরেজিতে।


কেউ একজন বললো, হ্যাঁ। লোকটি মাথা নাড়লো, আঙুল দেখালো সিঁড়ির দিকে।


"সে আমাদের সাথে আমাদের রুম পর্যন্ত আসেনি, তাকে ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিতও মনে হয়নি।"


গ্রুপটি একটি বেডরুমে ফিরে এলো, তারা একমত হলো যে ওই হোটেলে কর্মকর্তার সাথে দেখা হওয়াতে তারা হুমকি অনুভব করেননি। কয়েকজন বললো তারা আবার যাবে সেখানে।


পাঁচতলায় গিয়ে ওই গ্রুপের একজন একটা দরজা খুললো। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল একটা ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। আরেকজন আরেকটি দরজা খুলে দেখতে পেলো, সেখান থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে আরেক তলায়।


"বলতে পারেন, একটা ফ্লোরের ভেতরই আরেকটা ফ্লোর।"


তারা আরো তালাবন্ধ কক্ষ এবং দেয়ালে লাগানো আরো পোস্টার দেখতে পেলেন। সানের কোরিয়ান ভাষা জানা ছিল না। কিন্তু ইউটিউবে তার ভিডিও তোলার পর তিনি এর কিছু বার্তার অর্থ জানতে পারলেন।


এসব পোস্টারে কিম পরিবারের শক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নেবার কথা আছে। একবিংশ শতাব্দীকে প্রযুক্তির যুগ বলে ঘোষণা করা হয়েছে আরেকটি পোস্টারে, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০র দশকের একটি কম্পিউটারের ছবি।


একটু পর আরেক জন হোটেল কর্মকর্তা সেখানে আবির্ভূত হলেন, এবং ভদ্রভাবে বললেন তাদের যার যার ঘরে ফিরে যেতে।


কিন্তু এরপরও কয়েকজন তৃতীয় বারের মতো ওই পাঁচতলায় গেলেন। এর মধ্যে দু'জন আলাদা হয়ে একটু আড়ালে গিয়ে চুমু খেলেন (এই তথ্য বের হয়েছিল অনেক বছর পর এক পুনর্মিলনীতে)।


এবার আরেকজন রক্ষী সেখানে এলেন, এবং আবারও শান্তভাবে তাদের ঘরে ফিরে যেতে বললেন।


"আমাদের সবারই বয়েস ছিল ২০-এর কোঠায়। আমার বোকা ও সরল ছিলাম। আমাদের কাছে ব্যাপারটা নির্দোষ এবং উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তার পরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা এখন যা জানি তা তখন জানলে এটা করতাম না।"


সান এবং তার সঙ্গীরা ভোর ৫টার দিকে যার যার ঘরে গেলেন। জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ফ্লাইটের জন্য তৈরি হলেন। তাদের মিনিবাস আসার কথা ঠিক দু'ঘন্টা পরই।


কিন্তু সকাল ৭টায় মিনিবাসে ওঠার পরই যখন হোটেল কর্মকর্তারা এসে তাদের বাস থেকে নামতে বললেন, তখন পুরো গ্রুপটির মধ্যেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লো।


গাইডরা বললো, তারা জানে যে গ্রুপের একজন সদস্য কি করেছে, এবং এখনই তাদের তা স্বীকার করতে হবে।


গ্রুপের কেউ কোনো কথা বললো না।


একজন কর্মকর্তা বললেন, ইয়াংগাকডো হোটেলের প্রাইভেট কক্ষ থেকে এমব্রয়ডারি করা তোয়ালে কেউ অনুমতি ছাড়া নিয়ে গেছে। গ্রুপটি যদি বাড়ি ফিরতে চায় তাহলে তোয়ালেগুলো ফেরত দিতে হবে।


কেউ দোষ স্বীকার করলো না।


টুর গাইডরা কর্মকর্তাদের সাথে একটা চুক্তি করলো। তারা যদি পেছন ফিরে বাস থেকে নেমে যায়, তাহলে অপরাধী তোয়ালেগুলো মাটির ওপর রেখে দেবে। এটাই হবে সমস্যা সমাধানের সবচাইতে দ্রুত পদ্ধতি।


রক্ষীরা মেনে নিলো।


চুরি করা তোয়ালে ফেরত পাওয়া গেল, কিন্তু চোর চিহ্নিত হলো না।


গ্রুপটি এরপর এয়ারপোর্টে গেল। উত্তর কোরিয়ান ভিসা ফেরত দিল। তাদের পাসপোর্টে সিল ছাড়াই তারা উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করলো।


সান এর পরের বছর মেডিক্যাল স্কুলে তার দ্বিতীয় বছরের পড়াশোনা শুরু করলেন। পাঁচ তলার কথা তার প্রায় মনেই ছিল না।


কিন্তু চার বছর পরের এক ঘটনা সব বদলে দিলো।


---------------


২০১৫ সালে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ওটো ভার্মবিয়ের উত্তর কোরিয়া বেড়াতে যান কেলভিন সানের মত ঠিক একই কর্মসূচি নিয়ে। তার টুর অপারেটরও ছিল সেই একই ইয়ং পাইয়োনিয়র টুরস, তিনি ছিলেনও সেই একই ইয়াংগাকডো হোটেলে।


উত্তর কোরিয়ান কর্মকর্তারা বলেন, ভার্মবিয়ের ওই হোটেল থেকে একটি উত্তর কোরিয়ান পোস্টার চুরি করার চেষ্টা করেছিলেন।


এর পর তার একটা সাজানো বিচার হয়, টিভিতে প্রচার হয় একটা জোর করে ধারণ করা স্বীকারোক্তি।


বন্দী অবস্থায় তিনি আহত হন এবং সংজ্ঞা হারান। আর কখনো তার জ্ঞান ফেরেনি।


২০১৭ সালের জুন মাসে ওটো ভার্মবিয়েরের মৃত্যু আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়।


সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে আভাস পাওয়া যায় যে ভার্মবিয়ের ওই হোটেলের এমন একটি অংশে গিয়েছিলেন, যা সাধারণ লোকের জন্য উন্মুক্ত নয়।


ওই হোটেলে আগে গেছেন এমন কয়েকজন বলেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সেই পাঁচ তলায় গিয়েছিলেন এবং দেয়াল থেকে কোন একটি প্রচারণামূলক পোস্টার সরিয়েছিলেন।


কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সরকার বা হোটেলে কর্তৃপক্ষ কখনোই তা নিশ্চিত করেনি, যেভাবে তারা কখনো পঞ্চম তলার অস্তিত্বের কথাও স্বীকার করেনি।


সান বলছেন, "আমরা যখন সেখানে ছিলাম তখন সেখানে এমন কোনো পোস্টার ছিল না যা খুলে নেয়া যাবে। সবই ছিল দেয়ালে আঁকা বা দেয়ালের সাথে পেরেক দিয়ে আটকানো। এমন নয় যে আমরা কিছু নেবার কথা ভেবেছি, কিন্তু সেখানে এমন কিছুই ছিল না যা আমাদের পক্ষে চুরি করা সম্ভব ছিল, ঘরের বাইরের জুতো দুটি ছাড়া।"


ভার্মবিয়েরের মৃত্যুর পর উত্তর কোরিয়ায় পর্যটনের দিকে সবার নজর পড়ে। ইয়ং পাইওনিয়র ট্যুরসসহ বেশ কিছু ট্যুর অপারেটর মার্কিন নাগরিকদের উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ওই হোটেলের পাঁচতলাটি একটি সার্ভিস ফ্লোর, যাতে কারো প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।


সান এখন একজন ডাক্তার। তিনি সুযোগ পেলেই এখনো ভ্রমণ করেন। তার ব্লগে হাজার হাজার ফলোয়ার রয়েছে। তবে এখন তিনি অন্য দেশে বেড়াতে গিয়ে কি করছেন সে সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক।


"ওটোর যা হয়েছে, তা আমার কাছে একটা মর্মান্তিক ব্যাপার। এখন আমরা যতটুকু জানি, তার ভিত্তিতে আমি সব পর্যটককে বলবো তারা যখন যে দেশে যায় সেই দেশের রীতিনীতিকে যেন সম্মান করে।"


"তবে ২০১১ সালে আমাদের জানা ছিল না যে আমরা কোন বাড়াবাড়ি করছি কিনা বা আমরা যা করছি তাতে ওটোর মতো দুঃখজনক পরিণতিও হতে পারতো।" সূত্র : বিবিসি


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com