জাফরানকে বলা হয় ইরানের লাল স্বর্ণ। জাফরান চাষ সহজ কাজ নয়। আবহাওয়াগত বৈচিত্র্য, উর্বর মাটি এবং কষ্টসহিষ্ণু মানুষের পক্ষেই সম্ভব জাফরান চাষ। আর ইরানের পরিশ্রমী কৃষকদের কল্যাণে এ দেশের মাটি হয়ে উঠেছে আল্লাহর নিয়ামতে পরিপূর্ণ। ইরানের মাটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও খ্যাত বিচিত্র উদ্ভিদের জন্য অনুকূল। খ্রিষ্টপূর্ব কাল থেকেই তাই ইরান ভূখণ্ডে বিচিত্র উদ্ভিদের চাষ হয়ে আসছে। বলা হয়ে থাকে যে ইরানিরাই সর্বপ্রথম জাতি যারা এসব মূল্যবান উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে এবং এগুলোর চাষবাস করে এসেছে দীর্ঘকাল আগে থেকে।
ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহ এবং হামেদানের আলভান্দ পাহাড়ের পাদদেশে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৯ থেকে ৭২৮ সালের মধ্যে মাদদের শাসনামলে এসব উদ্ভিদের চাষ করা হতো। সময়ের পরিক্রমায় জাফরান চাষাবাদের কাজ যে কেবল ইরানের অন্যান্য শহরে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ সালে ইরানে অ্যালেক্সান্ডারের হামলার ইতিহাসের সঙ্গে গ্রিস, রোম ও চীনে এই মূল্যবান উদ্ভিদ জাফরানের পরিচিতির একটা সম্পর্ক রয়েছে।
সবচেয়ে প্রাচীন তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী জাফরান ব্যবহারের ইতিহাস হাখামানেশিয় যুগ মানে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ থেকে ৫৫০ সাল পূর্বেকার। এ সময়কার একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ইরানি বাদশাহের দরবারে আনুমানিক এক কিলোগ্রাম জাফরান ব্যবহৃত হতো। বাদশাহর দরবারের চাহিদা অর্থাৎ এক কিলোগ্রাম জাফরান সংগ্রহ করতে দেড় থেকে দুই লাখ জাফরান ফুলের প্রয়োজন পড়তো। দেড় লাখ ফুল তুলতে একজন শ্রমিকের ৪০ ঘণ্টা সময় লাগতো। সারা বিশ্বে আনুমানিক ২০০ থেকে ৩০০ টন জাফরান উৎপন্ন হয়। এর প্রায় নব্বুই শতাংশই উৎপন্ন হয় ইরানে। আড়াই শ' টন জাফরানের জন্য ২৫ মিলিয়ন টন জাফরান ফুলের প্রয়োজন।
বিশ্ববাজারে "জাফরান" ও "ইরান" দুটি নাম পরস্পরের পরিপূরক হয়ে আছে। সমগ্র বিশ্বে জাফরান রপ্তানিতে ইরান ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। কারণ, জাফরান চাষে খুব বেশি পানির প্রয়োজন পড়ে না। তাই ইরানের বেশিরভাগ এলাকাই জাফরান চাষের উপযোগী।
বর্তমানে ইরানের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় জাফরানের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশ জাফরান চাষের জন্য অন্যতম সূতিকাগার হিসেবে সারা বিশ্বেই খ্যাতি অর্জন করেছে।
সুস্বাস্থ্য ফুল, মশলার রাজা, লাল সোনা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত এই জাফরান। উদ্ভিদ ও কৃষিবিদদের দৃষ্টিতে এই জাফরানের বিচিত্র গুণ রয়েছে।
জাফরানের পেঁয়াজ লাগানোর সময় হলো শরৎকাল। পেঁয়াজ থেকে পাতার বিকাশের সময় হলো শীতকাল। আর বসন্তকাল হলো জাফরানের কেশর তোলার সময়। জাফরান তোলার সময় দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে এ দৃশ্য দেখার জন্য। যেসব এলাকায় জাফরানের চাষ হয় সেসব এলাকা এ সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
জাফরানের ফুল বেগুনি রঙের। লাল রঙের লম্বা পুংকেশর মাত্র তিনটি পুংকেশর হয় একটি ফুলে। এই কেশরগুলোই জাফরান নামে পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মশলা জাফরান এই কেশর থেকেই উৎপন্ন হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাফরান ক্ষেত থেকে তুলতে হয়। তোলার পর খুব সাবধানে লাল কেশরগুলোকে ফুল থেকে আলাদা করতে হয়। তারপর সেগুলোকে যত্নের সঙ্গে শুকিয়ে নিতে হয় যাতে জাফরানের গুণ ও মান অটুট থাকে। সকালে সূর্য ওঠার সময় ফুল ফোটে আর দিনের শেষে মলিন হয়ে যায়। হাতে করে যত্নের সাথে গাছ থেকে ফুলগুলো তুলতে হয়।
আগেই বলা হয়েছে যে জাফরান একটি মূল্যবান উদ্ভিদ। এটি ওষুধ ও খাদ্য শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে ইরানের বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ জাকারিয়া রাজি, আবু আলি সিনা এবং আবু রেইহান বিরুনির মতো মহান মনীষীগণ জাফরানের ওষুধি গুণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত রেখে গেছেন। বহু রোগের নিরাময়ে জাফরান ব্যবহার করেছেন এবং ব্যবহার করার কথা বলে গেছেন তাঁরা। বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান দুরারোগ্য রোগ আলজেইমার, ক্যানসার কিংবা পারকিনসন্স রোগের চিকিৎসায় এই জাফরান খুবই কার্যকর। সূত্র : রেডিও তেহরান
বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]