শিরোনাম
সাত কলেজ নিয়ে জটিল সমীকরণে ঢাবি!
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০১৯, ১১:৪৮
সাত কলেজ নিয়ে জটিল সমীকরণে ঢাবি!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধিভুক্ত হওয়ার প্রায় আড়াই বছর পরও রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজের সংকট কাটেনি। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই সংকট বাড়ছে বলে জানিয়েছেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা।


এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অধিভুক্তি নিয়ে তাদের ভোগান্তির অভিযোগ এনে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এমন অসন্তোষের মধ্যে উভয়দিকের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে এখন সামাল দিতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। যেন জটিল সমীকরণে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।


২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।


এসব কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন করা, দ্রুত ফলাফল প্রকাশ, সেশনজট নিরসন প্রভৃতি বিষয়গুলো অধিভুক্তির মূল লক্ষ্য হলেও এসব লক্ষ্য অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা।


তাদের এমন অভিযোগ শুধু অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, সেশনজট লেগে যাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অভিযোগ এনে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে বেশ কয়েকবার আন্দোলন করেছেন। তারা বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম আশ্বাসও পেয়েছেন। আর এ আশ্বাস পেয়ে তারা আন্দোলন থেকে পিছুও হটেছেন।



সর্বশেষ তারা পরীক্ষায় গণহারে ফেল করানোর অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদসহ চার দফা দাবিতে টানা দুদিন (১৪ ও১৫ জুলাই) আন্দোলন করেছেন। এ সময় তাদের দাবিগুলো ছিল- ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন, গণহারে ফেল রোধ করে পুনরায় খাতা মূল্যায়ন, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পুনরায় পরীক্ষার মাধ্যমে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার সুযোগ এবং পরীক্ষার ফল তিন মাসের মধ্যে দেয়া।


পরে দাবি আদায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয়ে আলোচনায় বসে। পরে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তারা আন্দোলন স্থগিত করেন।


আর এ আশ্বাসের পর (১৬ জুলাই) দিবাগত রাতে পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের কারণে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের মিতু নামে এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় ঢাবিকে দায়ী করে (২০ জুলাই) ফের নীলক্ষেত মোড়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ থেকে তারা মিতু হত্যার কারণ উদঘাটনসহ সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের সংকট নিরসনে তাদের দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। এজন্য ঢাবি প্রশাসনকে সাত দিনের আলটিমেটামও দেন তারা। অন্যথায় ২৭ (জুলাই) থেকে ফের মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।



বারবার আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনকারী ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবু বকর বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে খেলছে। ফল প্রকাশে লম্বা সময় ব্যয় করা হচ্ছে, ভালো পরীক্ষা দিলেও উত্তরপত্রে প্রাপ্ত নম্বর দেয়া হচ্ছে না, ইচ্ছামতো শিক্ষার্থীদের ফেল করানো হচ্ছে- যেন দেখার কেউ নেই। ঢাবি কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।


ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না তাবাসসুম বিবার্তাকে বলেন, আমাদের ঢাবিতে অধিভুক্ত করার পর ভেবেছিলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনস্থকালীন যেসব সমস্যা ছিলে, সেগুলো সমাধান হবে, শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু ‍হিতে বিপরীত হলো।


ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবির বিবার্তাকে বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের বারবার রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। যতবারই নামি, শুধু আমাদের আশ্বাস দেয়। এরপর আর দাবি পূরণ হয় না।


এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল দাবিতে এর আগে বেশ কয়েকবার আন্দোলন করেছেন। তখন তাদেরও বিভিন্ন আশ্বাস দিয়েছে ঢাবি প্রশাসন। আর এ আশ্বাসে তারাও পিছু হটেছেন। এবার তারা আবার অধিভুক্তি বাতিলসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন, যা এখনো চলমান।


দাবি আদায়ে তারা টানা দুইদিন ( ১৭ ও ১৮ জুলাই) রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন। এ অবরোধ থেকে তার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। পরে রবিবার (২১ জুলাই) তারা পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিভিন্ন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অধিভুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে এদিন দুপুরে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের মতো আন্দোলন স্থগিত করেন।



এ আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনের মুখপাত্র ঢাবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল মিয়া বিবার্তাকে বলেন, সাত কলেজের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। শুধু তাদের কারণে আমাদের ভোগান্তি হওয়ায় আমরা চারদফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছি।


কী ধরনের ভোগান্তি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধিভুক্তদের কাজ করতে গিয়ে আমাদের ফলাফল দিতে দেরি করা হচ্ছে, আমাদের প্রশাসনিক কাজগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের ঢাবি শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেয়ায় আমাদের পরিচয় দিতে গিয়েও বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।


দাবির বিষয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই অধিভুক্ত সাত কলেজ বাতিল করা, দুই মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষার ফলাফল দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা এবং ক্যাম্পাসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও রিকশা ভাড়া নির্ধারণ করা।


অধিভুক্তি বাতিল কেন চান জানতে চাইলে ঢাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নিশাদুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যেখানে ঢাবি নিজেদের শিক্ষার্থীদের দেখভাল করতে পারে না, সেখানে আরো দুই লাখ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব কীভাবে নেয়? এজন্য আমাদের মূল দাবি হচ্ছে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করা।


সাত কলেজ অধিভুক্তি সমস্যা নিরসনে রবিবার (২১ জুলাই) বিকেলে ঢাবি উপাচার্য দেশের বাইরে থাকায় উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদের নেতৃত্বে আলোচনায় বসে ঢাবি প্রশাসন।


আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ঢাবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া হবে। অধিভুক্তিকরণে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হবে।


এক প্রশ্নের জবাবে উপ-উপাচার্য বলেন, অধিভুক্তি বাতিলের ইখতিয়ার আমাদের নেই। এটা সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্ত। আমরা যেটা পারি সেটা হচ্ছে এটাকে নতুন করে সাজাতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। যাতে করে আমাদের শিক্ষার্থীদের কোনো স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত না ঘটে।


এ সময় তিনি আরো বলেন, উপাচার্য দেশে ফিরলে বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও ডাকসুর সদস্যদের সঙ্গে সাত কলেজের সমস্যার সমাধানে আলোচনা করা হবে। এছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করব।



সংবাদ সম্মেলনে ঢাবি অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন সাত কলেজের সমন্বয়ক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম।


তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সাথে ওই সাত কলেজের শিক্ষা পরিচালনার কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। ঢাবি শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়ও কোনো ব্যাঘাত হবে না।


সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একে এম গোলাম রাব্বানী বিবার্তাকে বলেন, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে, আন্দোলন করে কোনোকিছুর সমাধান হতে পারে না। আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু সমাধান করা সম্ভব। আমরা ঢাবি ও অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর বিষয়ে ভাবছি। আর সেগুলো সমাধান করার চেষ্টাও করছি।


বিবার্তা/রাসেল/উজ্জ্বল/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com