শিরোনাম
ধর্ষণের কারাগার থেকে নারীর মুক্তি হবে কবে? (শেষ পর্ব)
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০১৯, ১৫:১৩
ধর্ষণের কারাগার থেকে নারীর মুক্তি হবে কবে? (শেষ পর্ব)
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

ধর্ষিতদের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। মিছিলে শ্লোগান উঠছে, অপরাধীর ফাঁসি চাই। আল্টিমেটাম দেয়া হচ্ছে কখনো ৪৮ ঘণ্টার, কখনো আবার তিন দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, অন্য ঘটনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় পুরনো ঘটনা।


বরিশালের গৌরনদীতে এক তরুণীকে অপহরণ করে ধর্ষণ, চট্টগ্রামের চরপাথরঘাটায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ, মৌলভীবাজারে ধর্ষণ চেষ্টার সময় চলন্ত অটোরিকশা থেকে লাফ দিয়ে এক কলেজ ছাত্রীর আহত হওয়া এসব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।দেশজুড়ে ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকা নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার এটা খণ্ডিত চিত্র মাত্র।


সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্ন ছবির অবাধ বিক্রি, সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী থেকে পোষাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমন কি ভিখারিনী রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে। ধর্ষকরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকছে না, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঘটাচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।


সম্প্রতি ধর্ষণের ভয়াবহতা ও ধর্ষণ পরবর্তী নির্যাতনের লোমহর্ষক সব ঘটনায় আতকে উঠছে দেশবাসী। ধর্ষণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, প্রতিটি পরিবারে যেমন কন্যা সন্তান আছে, তেমনি ধর্ষকরাও কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক মরণব্যাধি নির্মূলে প্রত্যেকটি পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি মিডিয়াতে এ ধরনের ঘটনা প্রচারে আরো কৌশলী হতে হবে।


আর সবচেয়ে বেশি আঙ্গুল ওঠে আইনের সঠিক প্রয়োগের উপর। লঘু পাপে গুরু শাস্তি আর গুরু পাপে লঘু শাস্তি দেয়ার একটা বিরুপ সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে সমগ্র ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক এমন দেশ আছে যারা ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়, ফলে ধর্ষণ করার কথা কেউ চিন্তা করতেও পারে না।


চীন: সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই দেশটিতে ধর্ষণের সাজা শুধু মৃত্যুদণ্ডই। ধর্ষণ প্রমাণ হলেই আর কোনো সাজা নয়, সরাসরি মৃত্যুদণ্ড। আর তা কার্যকর করা হয় অত্যন্ত দ্রুত।


ইরান: হয় ফাঁসি, না হয় গুলি। এভাবেই এদেশে শাস্তি দেয়া হয় ধর্ষককে। কারণ তারা মনে করে, দোষী ধর্ষিতা নন, ধর্ষকই এই কাজে আসল দোষী।


আফগানিস্তান: আফগানিস্তানে ধর্ষণের হার অত্যন্ত কম। তবে, সেখানে ধর্ষণ করে কেউ ধরা পড়লে সোজা মাথায় গুলি করে মারা হয়।


ফ্রান্স: ইউরোপের এই দেশটিতে নির্যাতিতার শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ধর্ষকের সাজা ঠিক করা হয়। তবে, ধরা পড়ার পর এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে কমপক্ষে ১৫ বছরের কারাদণ্ড। অপরাধ গুরুতর হলে তা বেড়ে হতে পারে ৩০ বছরও।


উত্তর কোরিয়া: এদেশে ধর্ষণের সাজা শুধুই মৃত্যুদণ্ড। অভিযোগের পর গ্রেফতার। তারপর অভিযোগ প্রমাণ হলে গুলি করে হত্যা করা হয় ধর্ষককে।


সৌদি আরব: এখানেও ধর্ষণের সাজা ভয়ঙ্কর। এখানে ধর্ষককে প্রকাশ্যেই পিটিয়ে মারা হয়। আর তাই এখানেও ধর্ষণের সংখ্যা অনেকটাই কম।


পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ধর্ষণের শাস্তির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, ‘ধর্ষণের পর হত্যার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড’-এমন বিধান দিয়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের তিনটি ধারাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। যে আইনটিকে রহিত করে ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ করে বাংলাদেশ সরকার। সে আইনে ধর্ষণ ও হত্যার সাজা মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবনের বিধানও রাখা হয়। তবে নতুন এ আইনের একটি ধারাকেও অসাংবিধানিক বলেছেন আপিল বিভাগ। যে ধারায় বলা হয়েছিল- ‘১৯৯৫ সালের আইনে করা মামলা সেই পুরোনো আইনেই চলবে’।



আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে ধর্ষণের পর হত্যা সংক্রান্ত পুরাতন ও নতুন সব ধরনের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। যেখানে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সাজা হিসেবে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল।


আইনজীবীদের মতে, কোনো অপরাধেরই একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অন্য শাস্তিও হতে পারে। দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে কেউ কম অপরাধী, আবার কেউ বেশি অপরাধীও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সংবিধান পরিপন্থী। কারণ, অপরাধের ধরন অনুযায়ী সাজা কম বা বেশি হতে পারে।


বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার নেকি আক্তার ধর্ষণের কারণে নারীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি নিয়ে বিবার্তাকে বলেন, নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে দৈহিক মিলন করাই তো ক্ষতিকর। আর সেখানে ধর্ষণ তো তার মানসিক ও শারীরিক সব কিছুর বিরুদ্ধেই। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ধর্ষিতার বিশেষ অঙ্গের। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখি সেখানে এত বেশি ক্ষত সৃষ্টি ও রক্তপাত হয় যে, নারীকে বাঁচাতেই হিমশিম খেতে হয়। এদের অনেকেরই ভবিষ্যতে বাচ্চা নিতে সমস্যা হয় বা লং টার্ম ইনফেকশনে ভুগতে হয়। বিভিন্ন সেক্স ডিজিজও দেখা দিতে পারে।


আর এর সুদূর প্রসারি প্রভাব পড়ে নারীর মানসিক স্বাস্থ্যে। তারা যদিও অনেক সময় নেয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে, তারপরেও যৌন মিলনটা তাদের কাছে আজীবনই একটা ভীতিকর ব্যাপার। যায় ফলে তাদের মানসিক প্রশান্তির জায়গাটা সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়- বলেন ডাক্তার নেকি আক্তার।


৩য় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছেন পুরান ঢাকার এক মা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি বিবার্তাকে বলেন, আসলে আমরা যখন আমার মেয়ের বয়সে ছিলাম, ধর্ষণ কি জিনিস জানতামই না। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমার ৯ বছরের মেয়ের সাথে আমার এসব নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। স্কুল থেকে বের হলেই আমি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকে পড়াশুনার কথা না জিজ্ঞেস করে জিজ্ঞেস করতে হয় কেউ কিছু বলেছে কিনা, বা আরো যা যা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা যায় আর কি। এসবের ভয়ে বাসায় ছেলে গৃহ শিক্ষক রাখতে পারছি না, স্কুলে আসলেও ভয়ে ভয়ে থাকি। সত্যি কথা বলতে, এধরনের অনেক ঘটনা তো দেশে ঘটছে, তাই শিক্ষকদের মতো মানুষকেও আর বিশ্বাস করতে পারি না। আর মেয়ের কথা কি বলব, আমি নিজেকেই তো নিরাপদ বোধ করি না, না বাসায়, না বাইরে।


বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com