ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকা তার প্রাচীন স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। পুরানো স্থাপনা (রাজ প্রাসাদ, পুরানো বিল্ডিং), মোঘল স্থাপনা, মসজিদ, মন্দির কি নেই এই তালিকায়।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পুরান ঢাকার ১২৪ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী ‘সিক্কাটুলি পুকুর’। এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বংশাল থানার সিক্কাটুলীতে অবস্থিত। এই পুকুর শতবছর ধরে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে আসছে।
পুকুরে মাছ চাষ হতে শুরু করে, সব বয়সী লোকদের গোসল, সাঁতার কাটা, হৈ-হুল্লর, নৌকা ভ্রমণ সর্বোপরি একটি বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে এলাকাবাসী। যেন রাজধানীর বুকে গ্রামীণ চিত্রকেই ফুটিয়ে তুলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দৈনন্দিন পানির চাহিদাও পূরণ করে আসছে এই পুকুর। এলাকার বৃষ্টির পানির জলাবদ্ধতা থেকেও রেহাই দেয় এ পুকুর। অগ্নিনির্বাপণের সময় জরুরি পানির প্রয়োজন মেটানো ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও রক্ষা করে চলেছে এটি।
কে, কখন কিভাবে এই পুকুরটি খনন করেন সে ব্যাপারে মতবিরোধ থাকলেও স্থানীয় সূত্রে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি হচ্ছে, তৎকালীন বংশালের স্থানীয় বাসিন্দা সিক্কাটুলী পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ছিলেন নুর মোহাম্মদ ও মুসলিম যুব সংঘের সভাপতি ছিলেন মীর মোস্তাক আহমেদ। মীর মোস্তাক আহমেদের স্ত্রীর নাম ছিল বোচা বিবি। জনসাধারণের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য বোচা বিবি তার দেনমোহরের টাকায় তখন নাজিরাবাজারসংলগ্ন সিক্কাটুলী পুকুরটি খনন করেন এবং এর পুকুরের পূর্বে একসঙ্গে খোদা মসজিদ স্থাপন করেন।
এলাকার একাধিক সূত্র মতে, ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান এডিসি সিরাজউদ্দৌলা পুকুরটির সংস্কার করেছিলেন। তিনি সরকারি অর্থায়নে ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে পুকুরটির চার পাশে বাঁধস্বরূপ ৩২ ইঞ্চি দেয়াল নির্মাণ ও এর গভীরতা বাড়ানোসহ বহুমুখী সংস্কার করেছিলেন।
এরপর আবার যখন পুকুরটি পরিত্যাক্ত হয় তখন ১৯৮১-৮২ সালে তৎকালীন ঢাকা সিটি মেয়র আবুল হাসানাত পুকুরের দক্ষিণ পাশের পাড় সংস্কার করেন। ১৯৯০ সালের পরে দীর্ঘ সময় পুকুরটির দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় এটি অযত্ন-অবহেলা ও ময়লা-আবর্জনায় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল পুকুরটি। পরে স্থানীয় সিক্কাটুলী মুসলিম যুব সংঘ ও পঞ্চায়েত কমিটি বাৎসরিক কর্মসূচির আওতায় পুকুরটিতে মাছের পোনা ছাড়া হয়। এ পোনামাছ বড় হলে তা এলাকাবাসীর মধ্যে বণ্টন করা হয়।
বর্তমানে পুকুরটিতে প্যাডেল বোটে করে বিনামূল্যে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলা রোধে জালি লাগানো হয়েছে। গোসলের জন্য ঘাট, চার পাশে সীমানা, মাটি খনন, সৌন্দর্য রক্ষার্থে পুকুর পাড়ে টবের মধ্যে গাছ, সিমেন্ট ও বালি দিয়ে তৈরি দোয়েল, হরিণ, মাছরাঙা স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে পুকুরটি এলাকাবাসী ও শিশু-কিশোরদের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২ বছর পূর্বের সংস্কার এখন মলিন হয়ে গেছে। পুকুরের পানি শেওলাযুক্ত। সীমানা প্রাচীরের আস্তর খসে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন বিবার্তাকে বলেন, ২ বছর আগে পুকুরটি সংস্কার করা হয়েছিল। এরপর এলাকার পরিবেশ অনেকটাই বদলে গেছে। বিকাল হলে প্রতিদিন আসতাম পুকুর পাড়ে। পুকুরকে ঘিরে এলাকাটি সব বয়সের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এলাকার শিশু-কিশোররা সবচেয়ে বেশি আনন্দ উপভোগ করে। তারা বিকাল হলেই নৌকায় ওঠার জন্য লাইন ধরে থাকে।
নাজিরাবাজার, হাজী ওসমান গনি রোড, আগাসাদেক রোড, আগামসি লেন, সাত রওজা, মাহুতটুলী, কায়েতটুলী, মুকিম বাজারসহ বংশাল এলাকার মানুষরা বিভিন্ন কাজে পুকুরটি ব্যবহার করে থাকে। এলাকাবাসীর দাবি, পুকুরটির চারপাশে বসার ব্যবস্থা ও গাছ লাগালে সবার জন্যই ভাল হবে।
পুকুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়জিত ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মালেক মিয়া বিবার্তাকে বলেন, আমি পুকুরের ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করি আর পুকুরের ঘাট পরিস্কার রাখি। এর বাইরে আমার কোনো কাজ নেই। আর এর জন্য আমাকে ওয়ার্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে খুব অল্প পরিমান টাকা দেয়া হয়। তিন বছর আগে একবার পুকুর পরিষ্কার করা হয়েছিল, এখন তো পানিতে অনেক শ্যাওলা হয়ে গেছে, তাই এখন কেউ গোসল করে না, শরীর চুলকায়। একটা নৌকা আছে যেটায় ছোট বাচ্চারা পুকুরে ঘুরে বেড়ায়, তবে সেটাও কমে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আগা সাদেক লেনের এক বাসিন্দা জানান, পুকুরের পাশের ওই গলির জায়গা পুকুরের ছিল, কিন্তু ১০ বছর আগে তা ভরাট করা হয়। পুকুরের জায়গা দখল করে জোরপূর্বক ভবন নির্মাণ করা হয়। শতবর্ষেরও অধিক পুরনো পুকুরটি কতিপয় ব্যক্তি তাদের নিজের দাবি করে দখল ও ভরাটের পাঁয়তারা করছে।
ঐতিহ্যবাহী পুকুরটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]