শিরোনাম
অযত্ন-অবহেলায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার!
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০১৯, ১০:০২
অযত্ন-অবহেলায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যারা আন্দোলন করে শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে অবস্থিত এই শহীদ মিনার ও ভাষা শহীদদের নিয়ে দেশের মানুষ গর্ববোধ করেন।


অথচ একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের আগে-পরে কিছুদিন এ শহীদ মিনারের কদর থাকলেও সারাবছরই অবহেলা আর অযত্নে পড়ে থাকে এ স্মৃতির মিনার।


দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে।


সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশে ময়লা-আবর্জনা পড়ে রয়েছে। পাখির মল-মূত্রে মিনারের পাদদেশের কিছু অংশ সাদা হয়ে আছে। দর্শনার্থীরা বাদামের খোসাসহ নানা ধরনের খাবারের উচ্ছিষ্ট মিনারের পাদদেশে ফেলছেন। ফলে মিনার প্রাঙ্গণ হয়ে উঠছে অপরিষ্কার আর অপরিচ্ছন্ন।



মিনারের মূল বেদীর দিকে ঢুকতেই দুই দিকে দুটি বড় সাইনবোর্ড রয়েছে। আর তাতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে, শহীদ মিনারের গাম্ভীর্য রক্ষা করুন। আর মূল বেদীতে জুতো পায়ে ওঠা ও বসা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।


এ নির্দেশনার পর কয়েক কদম সামনে গেলে বুঝা যায়, নির্দেশনাটি শুধু সাইনবোর্ডেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কেউ এটার তোয়াক্কা করছেন না। এখানে আগত অনেকে মিনারের মূল বেদিতে উঠে গল্প করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছামত মিনারের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেলফি তুলছেন। আবার অনেকে পায়ে জুতো নিয়েও মিনারের মূল বেদিতে উঠে পড়ছেন, আর সেখানে খোশ-গল্পতে মেতেছেন।


আবার কাউকে পরিবার নিয়ে মিনারের পাদদেশে বসে থাকতে দেখা যায় ৷ তখন তাদের ছোট সন্তানরা মূল বেদীতে উঠে খেলছেন। আর তারাও তৃপ্তি নিয়ে তাদের সে খেলা দেখছেন। এ যেন খেলার স্থান! আবার ছোট ছেলেদের মিনারের পাদদেশে সাইকেল চালাতেও দেখা যায়।



অবাক করার বিষয় হলো, কেউ তাদের নিষেধও করছে না। যেন শহীদ মিনারকে দেখার কেউ নেই?


বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা আসার সাথে সাথে এ এলাকায় ভীড়ও বাড়তে থাকে। মিনার প্রাঙ্গণে আলোর ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। দীর্ঘ দিন ধরে মিনারের পূর্ব পাশের কয়েকটি লাইট নষ্ট রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত আসলে এ এলাকায় অসামাজিক-অবৈধ কাজ চলে বলে জানা গেছে।


শহীদ মিনার এলাকার বাদাম বিক্রেতা আবদুর রশিদ বিবার্তাকে বলেন, শহীদ মিনার এলাকায় রাতে মাদকসেবীদের দেখা যায়। তারা সাধারণত বেদীর পেছনের অংশে বসে গাঁজা সেবনসহ বিভিন্ন ধরণের খারাপ কাজ করে। তাদের একটা সিণ্ডিকেটও রয়েছে।


মূল বেদীতে জুতো পায়ে দিয়ে বসে কয়েকজন যুবক খোশ-গল্পতে ব্যস্ত। জুতো পায়ে দিয়ে বেদীতে বসে আছেন কেন তাদের এ প্রশ্ন করলে প্রথমে তারা প্রতিবেদককে উত্তর না দিয়ে তার পরিচয় জানতে চায়। পরে প্রতিবেদক তার সাংবাদিকতার পরিচয় দিলে তারা উত্তরে বলেন, আমরা এখানে প্রায়ই আসি। আর জুতোও খুলি না। কিন্তু কেউ তো কিছু বলে না।


কেউ কিছু না বললেও আপনারা জুতো নিয়ে এখানে বসতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা জানি এটা ঠিক নয়। এরপরে তারা সেখান থেকে উঠে যান।



শহীদ মিনারের মূল বেদীর পাশে আরো কয়েকজন যুবক সিগারেট টানতে টানতে বাদাম খেয়ে উচ্ছিষ্টাংশ মিনারের পাদদেশে ফেলছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদক তাদের পরিচয় জানতে চাইলে একজন বলেন, তার নাম আশিক ইসলাম। তিনি বাবুবাজার থেকে বন্ধুদের নিয়ে শহীদ মিনারে এসেছেন।


কি উদ্দেশে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘুরতে ও আড্ডা দিতে এসেছি। শহীদ মিনার আড্ডা দেয়ার জায়গা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই এখানে আড্ডা দেয় তাই আমরাও আড্ডা দিচ্ছি। সবার এখানে আড্ডা দেয়ার বিষয়টা ঠিক হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে বন্ধুদের নিয়ে অন্যত্র চলে যান।


শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল আমিন শিকদার সুজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এটা কোনো বিনোদন পার্ক। মানুষ ইচ্ছেমত যা খুশি, তা এখানে করছে। এমনকি অসামাজিক-অবৈধ কাজও এখানে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থান এভাবে মর্যাদাহানি হচ্ছে বিষয়টা ভাবতে অবাক লাগছে। কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখা উচিত।


নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বিবার্তাকে বলেন, কোনো বড় ধরনের অনুষ্ঠান ছাড়া এখানে আমাদের তেমন ডিউটি দেয়া হয় না। যার ফলে এখানে শহীদ মিনার অবমাননাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে শহীদ মিনারকে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তার জোরদারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, ভাষার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করলেন তাদের স্মৃতি বিজড়িত শহীদ মিনারের অযত্ন-অবহেলার কথা মেনে নেয়া যায় না। তবুও কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দিচ্ছেন না। নৈতিকতার দিক থেকেই শহীদ মিনারের প্রতি আমাদের যথাযথ সম্মান ও গুরুত্ব দেয়া উচিত।


ভাষাসৈনিক রেজাউল করিম মুঠোফোনে বিবার্তাকে বলেন, ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এ বিষয়টা আমাদের খুব দুঃখ দেয়। আমরা আরো বেশি দুঃখ পাই যখন শুনি, আমার বন্ধুদের বুকের উপরে জুতো পরে ঘুরে বেড়ানো হয়। সরকারের উচিত শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।


শহীদ মিনারের দায়িত্বে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রাব্বানী বিবার্তাকে বলেন, শহীদ মিনারের দায়িত্ব মূলত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। তারপরেও এটা যেহেতু আমাদের কাছে, সেহেতু আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে এটার দেখাশুনা করি। এটির দেখাশোনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও শহীদ মিনার সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই করা হয়।


অযত্ন-অবহেলার বিষয়ে তিনি বলেন, অযত্ন-অবহেলার বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ মিনারে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্যও বলা হয়েছে। শহীদ মিনারের সম্মান রক্ষার্থে সবাইকে সচেতন থাকার আহবান জানান তিনি।


বিবার্তা/রাসেল/উজ্জ্বল/জাকিয়া




সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com