ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল
বিচিত্র নামের ঢাকা হল
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৪২
বিচিত্র নামের ঢাকা হল
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা হল- বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের প্রতিষ্ঠিত তিনটি আবাসিক হলের একটি। বাংলাদেশের ইতিহাস, শিক্ষা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে এই হলটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।


ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল কার্জন হলের ঠিক পেছনে অবস্থিত। এখানে আবাসিক ছাত্রদের থাকার জন্য দুটি সম্প্রসারিত ভবনসহ একটি প্রধান ভবন রয়েছে। বর্তমানে এই হলে কেবল বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।



ইতিহাস
বর্তমান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল ছিল ঢাকা কলেজের জন্য নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাস। ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।


জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ রচিত ঢাকা কলেজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য ১৮৪১-১৯২১ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯০৮ সালে ঢাকা কলেজের জন্য পরিকল্পিতভাবে নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাস এটি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কোনো সরকারি কলেজের জন্য নির্মিত প্রথম ছাত্রাবাসও এটি।



ঢাকা কলেজ কার্জন হলে স্থানান্তরিত হলে কলেজের হিন্দু শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল হিসাবে এটি ব্যবহৃত হত। পরে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ধর্মনিরপেক্ষ (কসমোপলিটন) হলে রূপান্তরিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাস ঢাকা হলে রূপান্তরের পর, হলটিতে জগন্নাথ ও ঢাকা উভয় হলের শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক মুসলিম হলে পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় ১৯৫২ সালে ঢাকা হলের মূল ভবনের পূর্ব অংশটি ফজলুল হক মুসলিম হলের সম্প্রসারণ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অবশ্য, ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক সমস্যা সমাধানের পরে ঢাকা হল তার মূল ভবনের পূর্বাংশ পুনরায় ফেরত পায়। ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা হল জগন্নাথ হলের সঙ্গে তার যুক্ত পরিচয় থেকে আলাদা হয়ে যায়।



এই হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এফ. সি. টার্নার। পরবর্তী প্রভোস্ট হন জর্জ হ্যারি ল্যাংলি। ১৯২৪-২৫ সালে প্রভোস্ট হয়ে আসেন ওয়াল্টার এ. জেঙ্কিন্স। পরে ল্যাংলি ও জেঙ্কিন্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। এই হলের প্রাধ্যক্ষদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন- প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রমুখ।


নামকরণ
১৯২১ সালে হলটি লাইটন হল নামে প্রতিষ্ঠিত ও পরবর্তীকালে একে ঢাকা হল নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাতত্ববিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রথম প্রভোস্ট ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে হলটি ‘শহীদুল্লাহ্ হল’ নামকরণ করা হয়। ১৭ জুন, ২০১৭ সালে সিনেটের এক অধিবেশনে শহীদুল্লাহ্ হলের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি উত্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তখন হলের নাম পরিবর্তন করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল করা হয়।


আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদুল্লাহ্ হল
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতিশয় গৌরবময় ও খ্যাতিতে ভাস্বর। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের আন্দোলন, ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে হলটির ছাত্ররা তাদের দেশপ্রেম, ত্যাগ ও বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।



১৯৫২ সালে এই হলের পুকুর ঘাটে বসেই ১৪৪ ধারা ভেঙে ভাষা আন্দোলনের মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।


১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইয়ুব খানের অপশাসন ও দমনমূলক শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ঢাকা হলকে ঘিরে বিশাল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হল কেন্দ্রিক এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ আইয়ুবের সহযোগীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন পণ্ড করে দেয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বাধীনতাকামী জনতার আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বুলেটের আঘাতে শহিদ হন শহীদুল্লাহ্‌ হলের মেধাবী ছাত্র আসাদ। এই হত্যাকাণ্ডের পর ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন গণিত বিভাগের প্রতিভাবান সহকারী আবাসিক শিক্ষক শরাফত আলী, ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম। তারা দু’জন পুরাতন ডাইনিং সংলগ্ন দোতলায় বসবাস করতেন। তাছাড়াও জালাল হায়দার নামে একজন শিক্ষার্থী হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত হয় বলে জানা যায়। এই হলের অনেক ছাত্র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীরবিক্রম খেতাব অর্জন করেন।


পড়াশুনার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়াঙ্গণ এবং শৃঙ্খলায় এ হলের ছাত্রদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। হলের কৃতি ছাত্ররা তাদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছেন এবং দেশ মাতৃকার সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। এ হল থেকেই বেরিয়েছে অসংখ্য মেধাবী মুখ- যারা পরবর্তীতে হয়েছেন সফল শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, মন্ত্রী-এমপি, সচিব আর দক্ষ প্রশাসক।


গঠন ও সুযোগ সুবিধা
তিনতলা মূল ভবনটি ১৯২১ সালে নির্মাণ করা হয়- যেটি কার্জন হলের নকশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নির্মাণের সময় এটি ছিল ৪৩,৬৫০ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট লাল ইট দিয়ে তৈরি একটি বর্গাকার ইমারত। পরবর্তী সময়ে দুটি পাঁচতলা ভবন (শহিদ শরাফত আলী ভবন এবং শহিদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবন) সংযুক্ত করে নির্মিত। হল কমপ্লেক্সটি প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এবং এতে বর্তমানে আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিকসহ ১২৪০ জন এবং ১৩০০ জন অনাবাসী শিক্ষার্থী রয়েছে। মূল ভবনের উত্তর পার্শ্বে ১৯২৫ সালে নির্মিত লিটন হলটি ঢাকা হল তথা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের প্রভোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঢাকা হল এবং লিটন হলের মধ্যবর্তী স্থানে ‘লিটন হল অডিটোরিয়াম’ নির্মিত হয়েছিল। মিলনায়তনটি গত শতাব্দীর আশির দশকে নামাজের স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ২০০৭ সালে নামাজের স্থানটি স্থানান্তরিত হলে অডিটরিয়ামটি পূর্বের অবস্থা ফিরে পায়।


মূল ভবনের পশ্চিম পাশে একটি প্রশস্ত দ্বিতল ভবন রয়েছে যা ওল্ড ডাইনিং হল নামে পরিচিত। ডাইনিংরুমের উত্তর পাশে আরও একটি রিডিং রুম চালু করা হয়। ডাইনিংয়ের দ্বিতীয় তলাটি একসময় হল মিলনায়তন ও কমনরুম হিসাবে ব্যবহৃত হতো।



আশির দশকে জগন্নাথ হলের দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার পর ছাত্রদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে হল কর্তৃপক্ষ ২০০১ সালের ১০ মে কমনরুমটি সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য অস্থায়ীভাবে অডিটোরিয়ামের উত্তরাংশ শহিদ শরাফত আলী রিডিং রুম খোলা হয়। ২০০৭ সালে হল কর্তৃপক্ষ ডাইনিং হলের উপরের মিলনায়তনটি হল জামে মসজিদ হিসাবে চালু করে, যাতে ১০০০ মুসল্লি জামাতে নামাজ পড়তে পারেন। শহিদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবনের উত্তরে হলের প্রাক্তন প্রভোস্ট ড. আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী স্মরণে তিন তলা ভবন নির্মিত হয়। এই ভবনে হল ছাত্র সংসদ ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের অফিসসমূহ এবং টিভি রুমের ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটির নিচতলা শিক্ষার্থীদের ক্যান্টিন ও মেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হল কমপ্লেক্সের অন্যান্য ভবনগুলির মধ্যে রয়েছে প্রভোস্ট বাংলো, গ্রন্থাগার, সেলুন, এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। হল কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে একটি বিশাল খেলার মাঠ ও পুকুর রয়েছে।


শহীদুল্লাহ্ হল এলাকার পূর্বের নাম ছিল বাগ-এ-মুসা খাঁ। এটি বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ভূঁইয়া ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁয়ের নামে নামাঙ্করণ করা হয়। মুসা খাঁ সুবেদার ইসলাম খাঁয়ের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হবার পর যুদ্ধাবন্দি হিসেবে আটক ছিল। তবে সুবেদার ইসলাম খাঁ তার প্রতি বেশ সহৃদয় ছিল। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে এটি একটি বাগান ছিল যা মুসলিম বাগান হিসেবেও বিখ্যাত ছিল। সেই সময়ের নিদর্শন হিসাবে রয়েছে মুসা খাঁয়ের মসজিদ ও সমাধি।



শহীদুল্লাহ্ হলের মানুষখেকো পুকুর
লোকমুখে প্রচলিত আছে শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরে প্রতিবছর একজন করে মারা যায়। এখানে বসতকরা অতিপ্রাকৃত শক্তি নাকি মানুষকে ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই। জানা যায়, এই পুকুরের গভীরতা বেশি এবং অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়ায় যে কারো জন্য পুকুরে সাঁতার কাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফলে সাঁতারু অদক্ষ হলে ডুবে মৃত্যু হয়। এজন্য পুকুরে সাঁতার কাটা, গোসল করা ও পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসা নিষেধ করে নোটিশ বোর্ড টানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।


ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের বর্তমান প্রভোস্ট ড. মুহাম্মদ জাবেদ হোসেন বিবার্তাকে জানান, ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আছে। এই হলে আগে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা থাকত। একসময় জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের এখানে এলটমেন্ট দেওয়া হতো। তখন ঢাকা হল আর জগন্নাথ হল একসাথে পরিচালিত হতো। পরে অবশ্য আলাদা হয়ে যায়। বর্তমানে হলটি সায়েন্সে পড়ুয়া মুসলিম ছাত্রদের জন্যই নির্ধারিত। হলটি সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- সকল ক্ষেত্রেই একটা বড় অবদান রেখেছে। এই হলের ইতিহাস মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস।


ঝুঁকিপূর্ণ পুকুরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই পুকুর নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। এগুলো আসলে সত্য না। এসবের বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। পুকুরটা আসলে গভীর আর এর পানির মান আদর্শই আছে। এখানে যেসব মৃত্যু হয়েছে সবই অসাবধানতার কারণে।


শহীদুল্লাহ্ হলের সার্বিক বিষয়ে তিনি জানান, এই হলের শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে আসছি। এখানকার শিক্ষার্থীরা অনেক একটিভ। তারা বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিয়োজিত। আমাদের হলে 'বাধন' নামে একটা সংগঠন আছে যেখানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছে। আর হল প্রশাসন থেকে আমরা এই বছর একটা ম্যাগাজিন বের করেছি 'শতদল' নামে। এটা শেষবার ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা আবার চালু করলাম। ম্যাগাজিনে আমাদের হল সম্পর্কে বিস্তারিত অনেক তথ্য আছে।


বিবার্তা/রোমেল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com