ঢাবির ভর্তিতে ট্রান্সজেন্ডার কোটা
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:২০
ঢাবির ভর্তিতে ট্রান্সজেন্ডার কোটা
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিবছরই কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী কোটার মাধ্যমে ভর্তি হয়। সাধারণত কোটার ক্ষেত্রে বিশেষ সম্প্রদায় এবং সুবিধাবঞ্চিতরা কোটার জন্য মনোনীত হয়ে থাকে।


সম্প্রতি ২০২৩-২৪ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবন্ধী কোটার অংশে হিজড়া শব্দের পাশে "ট্রান্সজেন্ডার" শব্দ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর মাঝে তৈরি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তারা ট্রান্সজেন্ডারদের কোটা দেওয়ার বিরোধিতা করে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন লেখালেখি করছেন। এছাড়াও, বৃহস্পতিবার সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তারা আন্দোলন করেন এবং লিফলেট ও বিতরণ করেন।উক্ত বিষয় নিয়ে তারা উপাচার্য বরাবর অভিযোগও পাঠিয়েছেন।


উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তা/কর্মচারীর ওয়ার্ড কোটা (কেবল ছেলে/মেয়ে/স্বামী/স্ত্রী), উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হরিজন ও দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী (দৃষ্টি, বাক, শ্রবণ, শারীরিক, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস ও ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া), মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/মুক্তিযোদ্ধার নাতি/নাতনীসহ, খেলোয়াড় (শুধুমাত্র বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'বিকেএসপি' থেকে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র/ছাত্রী)। এসব কোটার মধ্যে প্রতিবন্ধী কোটা হলো ঐসকল শিক্ষার্থীর জন্য যারা শারীরিকভাবে কোনো ধরনের ত্রুটির সম্মুখীন। সুস্থসবল কেউ প্রতিবন্ধী কোটার জন্য মনোনীত হবে না। একজন ব্যক্তি যদি নিজেকে প্রতিবন্ধী দাবি করে তবে তাকে অবশ্যই সঠিকতার সনদপত্র প্রদর্শন করে তা প্রমাণ করতে হবে।


গত বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের আন্ডারগ্রাজুয়েট (স্নাতক) প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ট্রান্সজেন্ডার কোটা’ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ট্রান্সজেন্ডার বিরোধী লেখা সম্বলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে ট্রান্সজেন্ডার কোটা বিলুপ্তির জন্য বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। পরে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে স্মারকলিপি প্রদান করেন।


মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত জাকারিয়া বলেন, হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার এক নয়। কিন্তু হিজড়া সম্প্রদায়ের সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়ে ‘বিকৃত মস্তিষ্কের ট্রান্স’দের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ দেয়া হচ্ছে। একমাত্র কোটা তারাই দাবি করতে পারে যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জাতি। কিন্তু কী যুক্তির ওপরে কোনো ধরনের শারীরিক সীমাবদ্ধতা ছাড়া ট্রান্সজেন্ডার কোটা চালু করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। ট্রান্সজেন্ডারদেরকে কোটা দেয়ার অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এলজিবিটিকে সমর্থন দেয়া।



বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, হিজড়াদের কোটা থাকা যুক্তিযুক্ত, কিন্তু ট্রান্সদের কোটা দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই৷ নিজেদের বিকৃত করে কোটার দাবিদার হওয়া যায় না।


শিক্ষার্থীরা জানান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে একজন ট্রান্সমানুষ কখনোই তার শরীরের শতভাগ পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পরিবর্তন করতে পারে। বাকি ৮০ শতাংশই তাদের অপরিবর্তিত থেকে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টা থেকেই যায়।


প্রসঙ্গত, হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার আলাদা। হিজড়া হচ্ছে জন্মগতভাবে যেসব নারী /পুরুষ শারীরিকভাবে ত্রুটির সম্মুখীন হয়ে থাকে তাদের বোঝানো হয় আর ট্রান্সজেন্ডার বলতে বোঝানো হচ্ছে রূপান্তরকামী নারী বা পুরুষদের যারা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ তবে মানসিকভাবে তারা নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের দাবি করে। অর্থাৎ একজন পুরুষ নিজেকে নারী দাবি করছে /একজন নারী নিজেকে পুরুষ দাবি করছে। একজন হিজড়া শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি কিন্তু একজন ট্রান্সজেন্ডার হলো সমকামী। ট্রান্সজেন্ডার নারী বা পুরুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা পাওয়া এবং ভর্তির পর তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি তাদের কোটার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে একজন ট্রান্স পুরুষ ক্যাম্পাসে সুযোগ সুবিধা এবং ক্ষেত্র ব্যবহার শুরু করবে। যেমন তারা মেয়েদের ওয়াশরুম ব্যবহার করবে, মেয়েদের হলে থাকা শুরু করবে ইত্যাদি।



শিক্ষার্থীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ট্রান্সজেন্ডার কোটার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'এলজিবিটিকিউ' কালচারকে প্রমোট করা হচ্ছে। কেবল হিজড়া সম্প্রদায়কে বোঝানোর জন্য ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, রূপান্তরকামীদের জন্যও ব্যবহার হয়েছে।


শিক্ষার্থীদের দাবি


◑ অনতিবিলম্বে ভর্তি পরীক্ষায় ট্রান্সজেন্ডার কোটা বাতিল করা


◑ দ্রুত সময়ে এই ভর্তি বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা


◑ হিজরা জনগোষ্ঠীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া


◑ ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়ধারীদের কোটা ব্যবস্থায় আনার মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদকে প্রমোট করে আইন এবং সংবিধান বিরোধী কাজ করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্ষমা চাওয়া।


তবে তারা জানিয়েছে, আলোচনার ভিত্তিতে এ দাবিগুলো পরিবর্তন করা হতে পারে।


হিজড়া অর্থে ট্রান্সজেন্ডার লেখা যাবে কি না সেই প্রসঙ্গে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অমিয় সৃজন সৌম্য বিবার্তাকে বলেন, একাডেমিক্যালি হিজড়া অর্থে ট্রান্সজেন্ডার শব্দের ব্যবহার ভুল নয়। কারণ ট্রান্সজেন্ডার একটা বড় অর্থে ব্যবহার হয়। Transgender is a bigger umbrella. এখানে হিজড়া ছাড়াও অনেক বিষয় আছে তবে হিজড়ার বিষয়টা ট্রান্সজেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি হিজড়া অর্থে ট্রান্সজেন্ডার শব্দ ব্যবহার করে তবে সেটা ভুল নয়। ট্রান্সজেন্ডার শব্দের সাথে শিক্ষার্থীরা আবার 'এলজিবিটিকিউ' এক ভেবে নিলে সেটা ঠিক হবে না। কারণ এই দুইটা জিনিস সমার্থক নয়। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে জিজ্ঞেস করতে পারে যে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটা কী অর্থে ব্যবহার হয়েছে কিন্তু এটা নিয়ে ক্লিয়ার না হয়ে আন্দোলন করাটা ঠিক নয়।


উক্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বিবার্তাকে জানান, ট্রান্সজেন্ডার বলতে হিজড়া সম্প্রদায়কেই বোঝানো হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করছে তারা মূলত বিষয়টা নিয়ে স্পষ্ট নয়। তারা বলছে ট্রান্সজেন্ডার মানে রূপান্তরকামী। কিন্তু রূপান্তরকামীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ট্রান্সসেক্সুয়াল শব্দটা। ট্রান্সসেক্সুয়াল তো প্রতিবন্ধী নয়। প্রতিবন্ধী কোটার ক্ষেত্রে আমরা বুঝিয়েছি হিজড়াদের।


উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে কর্তৃপক্ষ প্রতিবন্ধী কোটা উল্লেখ করার সময় ব্রেকেটের ভেতর " দৃষ্টি, বাক, শ্রবণ, শারীরিক ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস, ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া " উল্লেখ করেন। এখানে ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া শব্দের মাঝখানে "কমা" ব্যবহার না করে "বা" অর্থে "/" এই চিহ্নটি ব্যবহার করেন যেখানে স্পষ্ট হয় হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার দুটি শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।


বিবার্তা/ছাব্বির/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com