শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ভূমিকা রাখছে?
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:৫১
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ভূমিকা রাখছে?
মো. ছাব্বিরুল ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলো। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আদৌও কি কিছু করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন- জিজ্ঞাসা সবার।


প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আগস্টের ২১ তারিখে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহের পর ১৯ সেপ্টেম্বর জিয়া হলের শিক্ষার্থীর মৃতদেহ পৌঁছালো ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক সমস্যার চিকিৎসার চেয়ে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনই বেশি দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে- তা দেখার বিষয়।


২০২১-২২ বার্ষিক বিবরণী মোতাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের কর্মসূচি হলো- শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম, ছাত্র-ছাত্রীদের খণ্ডকালীন চাকরি, কাউন্সেলিং কর্মসূচি, ওয়েবিনার, অনলাইন ওয়ার্কশপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা- সেশন ও আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, ‘ট্রমা ইনফর্মড টু এডুকেশন’ শিরোনামে কর্মশালা, বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উদযাপন, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন, ডিউক অব এডিনবার্গ এওয়ার্ড প্রোগ্রাম, দৃষ্টি-শ্রবণ ও অন্যান্য শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান।


শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বিবার্তাকে বলেন, আমরা প্রতিটা বিভাগ এবং হলে প্রচারণা চালিয়েছি। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয় নানারকম সেমিনার প্রতিনিয়ত আয়োজন করে যাচ্ছি। আমরা ডিপার্টমেন্টগুলোয় নোটিশ পাঠাই- যেন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সেমিনারগুলোতে উপস্থিত থাকতে পাঠায়। বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আমরা উদযাপন করে আসছি। কিছুদিন আগেও বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে আমাদের প্রোগ্রাম ছিল। এসব প্রোগ্রামে অনেক শিক্ষার্থী এটেন্ড করেছে। শিক্ষার্থীদের আহ্বান করার কোনো পথ বাকি রাখিনি। নিজেদের দিক থেকে সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করি।


শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় হলগুলোয় কেমন কাজ হচ্ছে- এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. মেহজাবীন হক জানান, মেয়েদের হলগুলোয় আমাদের সাইকোলজিস্ট নিযুক্ত আছে এবং মেয়েরা তাদের কাছ থেকে সেবা পাচ্ছে।


শিক্ষার্থীরা কেন মানসিক চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হয় না- এমন প্রশ্নে জবাবে এই সাইকোলজিস্ট বলেন, আমাদের কাছে অনেকেই এসেছে যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। আলহামদুলিল্লাহ তারা সুস্থ হয়েছেন। এখন যারা আত্মহত্যা করেছে এদের কেউই আমাদের কাছে কখনও সাহায্য নিতে আসেনি। সাহায্য নিতে এলে আমরা তাদের সাহায্য করতে পারতাম। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আমাদের কাছে সাহায্য নিতে আসে না। তারা এক প্রকার কুসংস্কারে আছে যে- এসব বিষয় নিজের মধ্যে রাখতে হয়।


মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় তিনি একে অপরকে সাহায্য করা, শিক্ষার্থীদের ইতস্ততা কাটানো, সচেতনতা সৃষ্টি এবং ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের সেবা নিতে সবাইকে আহ্বান জানান।


এ বিষয়ে এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জেন্ডার বড় ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় পুরুষের অনীহা বেশি। মানসিক চিকিৎসাও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজে ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া তাতে ছেলেদেরকে এমনভাবে গ্রুমিং করা হয় যাতে তারা নিজেদেরকে সমসময় শক্তিশালী ও দৃঢ় ভেবে নিজেদের কষ্ট চেপে রাখে। সাহায্য চাওয়া একজন ছেলের দুর্বলতা হিসেবে ধরা হয়। ফলে, কষ্টে থাকলেও ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সেবা নিতে কম আগ্রহ দেখায়।


তিনি আরও বলেন, আবাসিক শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে হলে ফুলটাইম কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট থাকা জরুরি।


উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে সমস্যায় ভুগলে ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের তিনতলায় স্টুডেন্ট কাউন্সিলিং এন্ড গাইডেন্স সেন্টারে আইডি কার্ড নিয়ে যেতে পারেন। সপ্তাহের রবি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সেবা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি কলা ভবনের পাঁচ তলায় নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপিতেও সেবা নিতে পারেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের হলগুলোয় কনসালটেন্ট নিযুক্ত আছে, যেখানে ফ্রি সেবা নিতে পারে ছাত্রীরা।


বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. নাজমুন নাহার বিবার্তাকে জানান, আমার হলে একজন মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি গত সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর আবার রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে সার্কুলার দিয়েছি। আরেকজন নিয়োগ দেব, কারণ আমার হলের মেয়েরা এটা চায় এবং তারা পছন্দ করে মনোবিজ্ঞানীর কনসাল্টেন্সি নিতে। মনোবিজ্ঞানীর জন্য একটা আলাদা রুমও আছে এই হলে। আমাদের যে হাউজ টিউটর তিনিও মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। মেয়েরা তাদের সকল ধরনের হতাশা, কথাবার্তা মনোবিজ্ঞানীর কাছে বলে; তাদের এটা ভালো লাগে। সপ্তাহে ৩ দিন এই সুবিধা থাকে। মেয়েদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আমরা যথেষ্ট সচেতন।


তবে মেয়েদের হলগুলোয় সাইকোলজিস্ট নিযুক্ত থাকলেও ছেলেদের হলগুলোয় কোনো সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি দেখা যায় মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে মানসিক সমস্যায় ভুগে আত্মহত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম ও জিয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী কাজী ফিরোজ।


আত্মহত্যার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি দেখেছি আমরা। কিন্তু ছেলেদের হলগুলোর মধ্যে বেশ কিছু হলে আগে সাইকোলজিস্ট নিযুক্ত ছিল কিন্তু এখন আর নেই। এক্ষেত্রে প্রভোস্টকে চাইতে হবে। প্রভোস্ট না চাইলে আমরা হলে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে পারি না। ছাত্ররা যদি প্রভোস্টের কাছে আবেদন করে তাহলে প্রভোস্ট সাইকোলজিস্ট চাইবেন। তখন আমরা হলগুলোয় সেবা দিতে পারব।


জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বিবার্তাকে জানান, মেয়েদের হলগুলোতে সাইকোলজিস্ট নিযুক্ত আছে কিন্তু ছেলেদের হলগুলোতে এরকম কোনো কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মানসিক স্বাস্থের কথা বিচার করে এখন এটার প্রয়োজনীয়তা হয়ে গেছে। আমাদের গত প্রভোস্ট কমিটিতেও এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে- ছেলেদের হলগুলোয় সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে।


তিনি আরো বলেন, শারীরিক চিকিৎসার মত মানসিক চিকিৎসাও যে প্রয়োজন- এটা এখনও বিশ্বব্যাপী নরমালাইজ করা হয়নি। কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে তার আশেপাশের মানুষ কীভাবে রিয়েক্ট করে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে অনেকেই এটাকে গুরুত্ব দেন না। তবে আশা করি সামনে এটা নিয়ে আমরা আরো অগ্রসর হবো।


সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি, বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করছি। চেষ্টা করছি প্রতিটা হলেই একজন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার। গত প্রভোস্ট কমিটিতে এই প্রস্তাবনাটা এসেছে। আমাদের চেষ্টা থাকে শিক্ষার্থীদের সকল সুযোগ সুবিধা দেওয়ার।


বিবার্তা/ছাব্বির/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com