জিপিএ-৫ পেয়েও মিলছে না কলেজ!
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:১৪
জিপিএ-৫ পেয়েও মিলছে না কলেজ!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

যেকোনো বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট দিলে আলোচনায় আসে জিপিএ-৫। এ নিয়ে চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে মহান সংসদ পর্যন্ত চলে আলোচনা। চলতি বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন শিক্ষার্থী, যা নিয়েও দেশব্যাপী তুমুল আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অবাক করার বিষয়, সর্বোচ্চ ফল জিপিএ-৫ পেয়েও চলতি বছর কলেজে ভর্তির ১ম ধাপে সুযোগ পায়নি ৮ হাজার ৫৫৮ জন শিক্ষার্থী! শিক্ষাবিদরা বলছেন, মেধার একমাত্র যোগ্যতা কখনই জিপিএ-৫ হতে পারে না। তাই মেধার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।


২৮ জুলাই, শুক্রবার চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করেছেন ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ছেলেদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও মেয়েদের ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।


২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। তাদের মধ্যে ছেলে ৮৪ হাজার ৯৬৪ জন ও মেয়ে ৯৮ হাজার ৬১৪ জন।


এসএসসির ফলাফল প্রকাশের পর গত ১০ আগস্ট সকাল থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন অনলাইনে শুরু হয়, যা চলে ২০ আগস্ট পর্যন্ত। পরে মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর ভর্তির জন্য যোগ্য শিক্ষার্থীদের ১ম ধাপের তালিকা প্রকাশ করে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড।


বোর্ডের প্রকাশিত কলেজ ভর্তির ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, চলতি বছর একাদশে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল ১৩ লাখ ৬ হাজার ৯৫৮ জন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। তার মধ্যে ১ম ধাপে বিভিন্ন কলেজ ও মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে ১২ লাখ ৬১ হাজার ৭৯৭ জন শিক্ষার্থী অর্থাৎ ভর্তির জন্য আবেদন করেও প্রথম ধাপেই সুযোগ পায়নি ৪৫ হাজার ১৬১ শিক্ষার্থী। আর এই বছর পাস করেও ৩ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদনই করেনি। শুধু তাই নয়, জিপিএ-৫ পেয়েও ১ম ধাপে কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়নি ৮ হাজার ৫৫৮ জন শিক্ষার্থী।


বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রথম ধাপে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার মধ্যে ভর্তির প্রাথমিক নিশ্চায়ন সম্পন্ন করতে হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিশ্চায়ন না করলে তাদের ফল বাতিল হয়েছে। পরে নতুন করে আবার তাদের আবেদন করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপের আবেদন ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে, যা চলবে ১৪ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপে ভর্তির আবেদনের সময়ও একজন শিক্ষার্থী সর্বনিম্ন পাঁচটি এবং সর্বোচ্চ ১০টি কলেজে পছন্দক্রম দিতে পারবেন। এ ধাপের আবেদনের ফল আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হবে। ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর নিশ্চায়নের সুযোগ পাবেন দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচিতরা। আগামী ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর তৃতীয় পর্যায়ের আবেদনের ফল ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হবে। আগামী ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয় ধাপের নিশ্চায়ন চলবে। আর ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ভর্তি কার্যক্রম। ক্লাস শুরু হবে ৮ অক্টোবর।


জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের কলেজ না পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর যে কলেজগুলো চয়েজ দিয়েছেন, হয়তো তার চেয়ে নম্বরে এগিয়ে থাকা আরো অনেক শিক্ষার্থী একই কলেজগুলোতে চয়েজে দিয়েছেন। ফলে কাউকে না কাউকে ভালো ফল সত্ত্বেও বাদ পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া কিছু কিছু ভালো কলেজের সাথে সংযুক্ত স্কুলও রয়েছে। যার কারণে তারা নিজেদের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভর্তি করায়। ফলে সেখানে বাহিরের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলেও তেমন আসন শূন্য থাকে না। তবে এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যারা ১ম পর্যায়ে কলেজ পায়নি, তারা দ্বিতীয় দফায় কলেজ পছন্দের ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে আবেদন করলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাবে।


এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের কলেজ না পাওয়ায় বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বিবার্তাকে বলেন, প্রথম সারির কলেজগুলো সবার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। সংযুক্ত স্কুল অ্যান্ড কলেজকে বেশি প্রাধান্য দেয়াসহ বেশ কিছু কারণে এটা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কলেজ না পাওয়ার সংখ্যায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বেশি। কারণ বিজ্ঞান বিভাগের ফলাফলও খুব ভালো হয়। তাই তাদের অধিকাংশের লক্ষ্য থাকে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। আর এসব কলেজের আসন চাহিদা অনুপাতে কম হওয়ায় অনেককে বাদ পড়তে হচ্ছে।


আসন সংকট রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসন সংকট নেই। যারা এখন কলেজ পায়নি, তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে আবেদন করে কলেজ পেয়ে যাবেন।


জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের কলেজ না পাওয়ার বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, মেধার একমাত্র যোগ্যতা কখনো জিপিএ-৫ হতে পারে না। তাই মেধার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।


এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, জিপিএ ৫ একটা পরীক্ষার স্বীকৃতি। যারা জিপিএ-৫ পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না, তাদের জন্য জিপিএ-৫ যোগ্যতায় আসন সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তাছাড়া আমাদের আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, মেধার একমাত্র যোগ্যতা কখনো জিপিএ-৫ হতে পারে না। আমি মনে করি, মেধার মূল্যায়নও হওয়া জরুরি। দেখা গেল, ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে অনেক সময় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ফেল করলেও কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থী পাস করে। আবার জিপিএ-৫ পাওয়া সব শিক্ষার্থী ফেল করে বিষয়টি এমনও নয়।


তিনি বলেন, শুধু জিপিএ-৫ এর প্রতিযোগিতা নয়, ছেলেমেয়েদের বিদ্যা অর্জনের দিকে ধাবিত করতে হবে। তারা কতটুকু শিখলো, সেই বিষয়টির গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী নয় বরং জ্ঞান অন্বেষণকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরীক্ষাটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, একটা পরীক্ষা দিয়ে হয়তো আমরা মূল্যায়ন করি। তবে পরীক্ষার মধ্যে শুধু শ্রেণিকক্ষের কারিকুলাম থাকবে এটা নয়, এখানেই শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, আচার-আচরণ, সৌজন্যবোধসহ সার্বিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই সবগুলো বিষয়ের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করলে ভালো ফলাফল আসবে বলে আশা করা যায়।


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, জিপিএ-৫ বিষয়টি বেশি আলোচিত মিডিয়া ও অভিভাবকদের কারণে। এটা একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের একমাত্র যোগ্যতা হতে পারে না। দেখা গেল, আগে যারা ৬০ শতাংশ মার্ক পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেত, তারা এখন ৮০ শতাংশ মার্ক পেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে। আগে একটা প্রশ্নের উত্তরে ১০ এ ৬ দেওয়া হলেও এখন কিন্তু অবলীলায় ৮ দেয়া হচ্ছে। মোটকথা, জিপিএ-৫ দিয়ে তেমন কিছু যায় আসে না।


জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, জিপিএ-৫ এর চেয়ে আসন কম থাকলে এটা তো হবেই। তবে আমি মনে করি ভালো কলেজ বলতে কিছু নেই। কিছু কলেজে টিউশন ফি দিয়ে পড়তে হয় আবার সরকারিগুলোতে তেমন খরচ নেই। কিন্তু সরকারিগুলোতে তেমন ক্লাস হয় না বললেই চলে। তারপরেও এগুলো অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের চয়েজের তালিকায় থাকে। এজন্য অনেকে বাদ পড়ে যায়। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা যে যেখানে পড়ুক, তাদের প্রকৃত শিক্ষাটা গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমি মনে করি শিক্ষার্থীর জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তার ভিতরে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে কিনা? সেটি ছোটবেলায় হোক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে হোক, সব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আর এ প্রশ্ন মানে তিন ঘণ্টার এক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া সেটি নয়। অনবরত শিক্ষার্থীদের মাঝে জিজ্ঞাসা থাকতে হবে। আর এ জিজ্ঞাসাটা আত্মজিজ্ঞাসা হোক, সমাজ জিজ্ঞাসা হোক, সেটি বিজ্ঞানের জিজ্ঞাসা হতে পারে অর্থাৎ জানার তৃষ্ণা তথা পিপাসা থাকতে হবে। সেটি শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে থাকবে, তা নয়। ক্লাসরুম যদি অংশগ্রহণমূলক হয়- সেটি খুবই কার্যকরী হবে। আসলেই প্রশ্ন করাটাই জ্ঞান চর্চার প্রথম জায়গা।


তিনি বলেন, জিপিএ-৫ সিস্টেম তো বিশ্বব্যাপী আছে। কম বেশি শিক্ষার্থীদের পারফরমেন্স মূল্যায়নের জন্য গ্রেডিং সিস্টেমটি থাকছে। আসলেই এগুলোর মূল যে জায়গাটা সেটি হচ্ছে, আমরা আদান-প্রদানটা নিজেদের মধ্যে করতে পারছি কিনা? শিক্ষাব্যবস্থাতে প্রতিযোগিতার একটা ব্যাপার থাকে, এটা শিক্ষার্থীদের পারফরমেন্স অ্যাসেস করে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক হয়ে নিজেদের অবস্থান সৃষ্টি করতে হচ্ছে। আর আমরাও সেটাই করছি। তবে হ্যাঁ, এখানে আরও নতুন করে ভাবা যেতে পারে, এই জিপিএটা আমরা কিসের ভিত্তিতে দিচ্ছি?


বিবার্তা/রাসেল/রোমেল/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com