গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল: দালাল সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি রোগীরা
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩, ০৯:২৫
গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল: দালাল সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি রোগীরা
আনোয়ার হোসেন শামীম, গাইবান্ধা
প্রিন্ট অ-অ+

আইনের তোয়াক্কা না করে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে আল মদিনা, মাইশা, আবির, আইডিয়াল, ইসলাম ডায়াগনস্টিকসহ বেশ কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। সরকারি হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের দোকানের মালিকরা দালাল দিয়ে রোগীদের ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। ফলে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ আদায়সহ চড়া দামে ওষুধও কিনতে হয়।


সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত মহিলা ও পুরুষ দালালের কেউ থাকেন ডাক্তারের রুমে, কেউ রোগী খোঁজেন, কেউ ব্যস্ত থাকেন নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ বিক্রিতে।


এই দালাল চক্রের মধ্যে নারীসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন প্রতিনিয়ত হাসপাতালে আসা বিভিন্ন রোগীকে হয়রানি করে। দালাল চক্রের কাছের জিম্মি রোগী এবং স্বজনরা।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার বিবার্তাকে বলেন, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালচক্র রোগীদের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত, দুর্দশাগ্রস্ত এবং অসহায় করে তোলে। মানুষের মৌলিক অধিকার সু-চিকিৎসা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালে গাইনি, মেজর-মাইনর অপারেশন ও প্যাথলজি পরীক্ষা, এক্স-রে, ইসিজি, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠসহ প্রায় সব পরীক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও কর্তব্যরত ডাক্তার অসহায় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে দালালদের হাতে তুলে দেন।


বৃহস্পতিবার সকাল। হাসপাতালের গেটে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে এক নারী রোগীর। তিনি সদর উপজেলার তুলসীঘাট এলাকার শিবপুর গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছিলেন ওই রোগী- তার সঙ্গে রয়েছেন এক নারী দালাল। রোগীদের ভাগিয়ে অন্যস্থানে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান এই সিন্ডিকেট। প্রথমে ওই রোগীর সঙ্গে থাকা নারীর পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তাতেই ওই নারী চমকে ওঠেন। তার নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। কথা বলার একপর্যায়ে সে তার নাম শ্রী শান্তনা রানী বলে জানান। রোগীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখন তো হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয় না। তাই রোগীকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য গাইবান্ধা ডিজিটাল ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছি।


হাসপাতালের আউটডোরে যেতেই দেখা মেলে আরেক দালালের সঙ্গে। তার নাম রত্না রানী। পাশে দাঁড়িয়ে এক নারী রোগী। রত্না রানীকে নাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন হাসপাতালে তার রোগী ভর্তি আছে। রোগীকে দেখতে যেতে চাইলে তিনি থমকে যান। একপর্যায়ে জানালেন, সাজিদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করেন তিনি। কথা শেষ না হতেই সেখান থেকে তাড়াহুড়ো করে সটকে পড়েন রত্না রানী।


পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নামে আশপাশে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে প্রবেশ করতেই রোগীদেও ভিড় চোখে পড়ে। সেখানে চিকিৎসা দিচ্ছেন সারওয়ার হোসেন তমাল নামে একজন ডাক্তার। পাশে ব্রিজ রোডের মিজান নামে এক বহিরাগতকে দেখা যায় ওই ডাক্তারকে স্লিপ সরবরাহ করতে। উনি হাসপাতালের স্টাফ কি না জানতে চাইলে তিনি তার বিষয়ে ডা. সারওয়ার হোসেন তমালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য। কিছু লেখে দেখেন, পরে এর মজা পাবেন।


পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সুমন মিয়ার শ্যালক মিজান। মিজান জরুরী বিভাগে থাকেন রোগী পটানোর জন্য। ডাক্তার রোগীকে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলেই তিনি আল-মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান।


এ বিষয়ে ডা. সারওয়ার হোসেন তমাল বিবার্তাকে বলেন, মিজান একজন স্বেচ্ছাসেবী। সে আমাদেরকে সহযোগিতা করেন। মিজান কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে কি না আমার জানা নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলুন।


হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা খলিলুর রহমান (৫২) বিবার্তাকে বলেন, হাসপাতালে শুধুমাত্র চিকিৎসাপত্র দেয়া হয়। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে হাসপাতালে পরীক্ষা না করে বাইরে যেতে বলেন। দালালচক্রের সঙ্গে হাসপাতালের লোকজনের যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে কোন ওষুধ দেয়া হয় না। ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।


হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেট থাকার কথা স্বীকার করে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. মো. মাহবুব হোসেন বিবার্তাকে বলেন, হাসপাতালে শুধুমাত্র এক্স-রে মেশিন ছাড়া সকল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সচল রয়েছে। চেষ্টা করছি আমরা ওই সিন্ডিকেটে জড়িতদের আটক করার জন্য। এতে যদি হাসপাতালের স্টাফও জড়িত থাকে তাদেরকে আইনে আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে আপনাদেরও ভূমিকা রয়েছে আমাদের সহযোগিতা করার।


এ বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক ডা. এবিএম আবু হানিফ বিবার্তাকে বলেন, এটা অবশ্যই আমাদের কাম্য নয়। দালালমুক্ত হাসপাতালের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জড়িতদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে বলা হয়েছে। সেবা নিতে এসে রোগীরা কেনো হয়রানি হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।


বিবার্তা/জবা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com