কুষ্টিয়া পৌরসভার 'গুরুত্বপূর্ণ' নথি চুরি, নেপথ্যে কী?
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৯
কুষ্টিয়া পৌরসভার 'গুরুত্বপূর্ণ' নথি চুরি, নেপথ্যে কী?
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

কুষ্টিয়া পৌরসভার জন্য আদায়কৃত অর্থ উন্নয়ন কাজে ব্যবহার না করে ভুয়া বিল-ভাউচারের আত্মসাৎ পূর্বক অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন মেয়র আনোয়ার আলী। এমন অভিযোগ ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করে আসছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।


সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র জমা দিতে পৌর মেয়রকে একটি চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিটি গ্রহণও করা হয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব কাগজপত্র আগামী ১৩ মার্চ দুদকের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশনাও রয়েছে চিঠিতে।


তবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র কার্যালয়ের তালা ভেঙে দু'টি ডিডিআর ও গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র জমা দেয়া যাবে কি-না এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে পৌরসভার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- যথাসময়ে কাগজপত্র জমা দেয়া হবে।


অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠা পৌর মেয়র আনোয়ার আলী এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও পৌরসভার সচিব বলছেন, দুদক যেসব অভিযোগের তদন্ত করছে- এসব সঠিক নয়। এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।


স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়রের অফিস কক্ষের তালা ভেঙে চুরির ঘটনা ঘটে। এসময় দুর্বৃত্তরা মেয়র কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ভিডিও সংরক্ষণের দুটি ডিডিআর, একটি ক্যামেরা ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নিয়ে যায় বলে দাবি করছে পৌর কর্তৃপক্ষ। মেয়রের কক্ষসহ তিনটি কক্ষের একাধিক আলমারি ভাঙা ও একটি সিন্দুক খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। খবর পেয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।


২৬ ফেব্রুয়ারি, রবিবার দুপুরে নিজ কার্যালয় চুরির ঘটনাকে গভীর যড়যন্ত্র উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলন করেন পৌর মেয়র আনোয়ার আলী। আর ওইদিন রাতে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহামুদ রেজা চৌধুরী বাদি হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন।


সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে মঙ্গলবার (৭ মার্চ) কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন খান বিবার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোন কিছু উদ্ধার করা যায়নি। বিষয়টি তদন্ত চলছে। সাইবার টিমসহ সবাই মিলে আমরা কাজ করছি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তের জন্য আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছি।


পৌর সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া পৌরসভায় ১৭ জন নিরাপত্তারক্ষী আছেন। এছাড়া পৌরসভার পুরো কার্যালয়ও ছিল সিসি ক্যামেরার আওতায়। এমন সংরক্ষিত এলাকায় এরপরও কিভাবে চুরি হলো? এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বিবার্তাকে বলেন, পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের পুরনো অভিযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম এ নিয়ে রাষ্ট্রের একটি সংস্থা তদন্ত করছিল। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পৌরসভায় টেন্ডার জমা নিয়ে ঝামেলা হয়। এরপর শনিবার রাতেই মেয়রের কক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ চুরি হয়ে যায়। আমার তো মনে হয়, এ সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগান হয়েছে।


এদিকে কুষ্টিয়া পৌরসভার জন্য আদায়কৃত অর্থ উন্নয়ন কাজে ব্যবহার না করে ভুয়া বিল-ভাউচারের আত্মসাৎপূর্বক অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পৌর মেয়র আনোয়ার আলীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সর্বশেষ দুদকের উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম মোড়ল অনুসন্ধানের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র জমা দিতে ইতোমধ্যে মেয়র বরাবর চিঠিও দিয়েছেন।


জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে পৌর মেয়রকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ মার্চ দুদকের কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিটি গ্রহণ করেন কুষ্টিয়া পৌরসভার সচিব মো. কামাল উদ্দিন।


দুদকের সমন্বিত কুষ্টিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম মোড়ল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমরা কোন অভিযোগ পেলে সেটির প্রাথমিক তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং অভিযোগের বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য হাইকমান্ডের অনুমতি চেয়ে আবেদন করি। তাদের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্তকাজ শুরু হয়েছে। কিছু নথিসহ তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোন অনিয়ম এবং অসঙ্গতি পাওয়া গেলে তখন আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।


তিনি আরো বলেন, এই অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাই কোন বক্তব্য দেয়া যাবে না। কমিশন থেকে নির্দেশ আছে। তদন্তের স্বার্থে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে।


চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পৌরকরের টাকা উন্নয়ন খাতে খরচ না করে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন। অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য দুদক সমন্বিত কুষ্টিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম মোড়লকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ১৩ মার্চের মধ্যে ২০২২–২৩ অর্থবছরের খাত ওয়ারি আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ পৌরসভার আওতাধীন সব দপ্তর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দেয়া করের তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে।


মেয়র বরাবার প্রেরিত বিবার্তায় রক্ষিত চিঠিতে দেখা যায়, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বর্ণিত রেকর্ডপত্র আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা বরাবর জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


চিঠিতে পৌরসভার পৌরকর নির্ধারণ সংক্রান্ত আইন ও ম্যানুয়ালের সত্যায়িত কপির পাশাপাশি ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত খাতওয়ারি হিসাব বিবরণী চাওয়া হয়েছে।



এছাড়া চিঠিতে পৌরসভার আওতাধীন ব্যবসা ও ভবনসমূহের ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পৌরকর নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি ও ধার্যকৃত পৌরকর আদায় রেজিস্টার এর সত্যায়িত ছায়ালিপিও জমা দিতে বলা হয়। ভবন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বিআরবি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, লাভলী টাওয়ার, সমবায় টাওয়ার, পরিমল টাওয়ার, ছয় রাস্তার মোড়ের ফটিক টাওয়ার ও খেয়া রেস্টুরেন্ট টাওয়ার, জেলা স্কুল সংলগ্ন শাহজাহান টাওয়ার, পুলিশ লাইন সংলগ্ন ফয়সাল টাওয়ার, উডল্যান্ড ও মনির প্লাইউড ফ্যাক্টরি।



অন্যদিকে পৌরসভাধীন আবাসিক হোটেলসমূহেরও ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পৌরকর নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি ও ধার্যকৃত পৌরকর আদায় রেজিস্টারে সত্যায়িত ছায়ালিপি চাওয়া হয়েছে চিঠিতে। আবাসিক হোটেলসমূহ হলো- দিশা টাওয়ার, রোজ ভিউ হোটেল, পদ্মা হোটেল, প্রীতম হোটেল, আজমিরি হোটেল, রিভারভি, হোটেল নুর ইন্টারন্যাশনাল, ডাইং ডিভাইন।



অন্যদিকে পৌরসভার অধীন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ২০১৫-১৬ হতে ২০২১-২২ বছর পর্যন্ত পৌরকর নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এর সত্যায়িত ছায়ালিপি এবং ধার্যকৃত পৌরকর আদায় রেজিস্ট্রারের সত্যায়িত ছায়ালিপি জমা দিতে বলা হয়েছে।


পাশাপাশি পৌরসভার অধীন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, টিটিসি, পূর্ত অফিস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, ওজোপাডিকো, বিটিসিএল, আরপিটিআই, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল, গৃহ সংস্থাপন, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, কলকারখানা পরিদর্শন অফিস, পিটিআই, পাবলিক লাইব্রেরিসহ অন্যান্য সরকারি হোল্ডিংয়ের ২০১৫-১৬ হতে ২০২১ অর্থ বছর পর্যন্ত পৌরকর নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং ধার্যকৃত পৌরকর আদায় রেজিস্ট্রারের সত্যায়িত ছায়ালিপি জমা দিতে বলা হয় চিঠিতে।


এছাড়া পৌরসভার অর্গানোগ্রামের সত্যায়িত ছায়ালিপির সাথে সাথে পৌরসভাটিতে বর্তমানে কর্মরত জনবলের (কর্মকর্তা-কর্মচারী) এর তালিকা চাওয়া হয়েছে প্রেরিত চিঠিতে কর্মরত শাখাসহ।


এ বিষয়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার সচিব কামাল উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে মেয়র মহোদয় বরাবর চিঠি এসেছে। আমরা তাদের চাওয়া সব ধরনের নথি এবং তথ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করব। তবে চিঠিতে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।


যার বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগ সেই মেয়র অবশ্য এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র জানেন না- যদিও ২০২২ সালের ৭ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ তদন্ত করে আসছে দুদক। এড়িয়ে গেছেন অভিযোগের ব্যাপারে।


জানতে চাইলে কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার আলী বিবার্তাকে বলেন, আমার কাছে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন চিঠি আসেনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কোন বক্তব্য নেই।


বিবার্তা/সোহেল-সানজিদা/রোমেল/কেআর

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com