ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ২৩:০৬
ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
সামিনা বিপাশা ও সাইদুল কাদের
প্রিন্ট অ-অ+

‘আজ দশ বছর হলো ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজন হচ্ছে। প্রথম দিকে এর থিম মোটামুটি ইংরেজি বা বিদেশি সাহিত্য সংস্কৃতি হলেও নানা সমালোচনার মুখে বর্তমানে এই আয়োজনে বেশ বড় একটা অংশ জুড়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য আলোচিত হচ্ছে। সংস্কৃতি যেহেতু স্থান-কাল পেরিয়ে সবাইকে স্পর্শ করতে পারে, ভাষা ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে একটা সার্বজনীন বার্তা নিয়ে হাজির হতে পারে, সেজন্য ঢাকা লিট ফেস্টের আয়োজনও মনে হয় ক্রমে এর তথাকথিত এলিটিস্ট চরিত্রে ছাড় দিয়ে বাংলা সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা যৌক্তিক রূপ নেওয়ার পথে অনেকটা এগিয়েছে।’ বিবার্তার সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।


জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন, দেশি-বিদেশি সাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতি এবং আলোচনা-সমালোচনার ঝড়কে সাথে নিয়ে ৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৮ জানুয়ারি শেষ হয়েছে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর দশম আসর।


‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে হে রিটের‌্যারি ফেস্টিভ্যাল নামে। তবে করোনা মহামারির কারণে টানা তিন বছর স্থগিত ছিল এই আয়োজন।



বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকদের পরিচয় এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যে আয়োজিত হয় লিট ফেস্ট। উৎসবে মূলত দেশি বিদেশি সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, লেখকদের বৈচিত্র্যময় সম্মেলন ঘটে। বিভিন্ন দেশের গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, কবিতা, অনুবাদ, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শন- এর সবই উৎসবে আলোচনার বিষয়বস্তু।



গত এক যুগ ধরে লিট ফেস্টের এই আয়োজনের কারণে বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার সাহিত্য চর্চা ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়েছে বলে মনে করেন লিট ফেস্টের আয়োজক ও ইংরেজি সাহিত্য সংশ্লিষ্টরা। এবারের আসরের আগেই লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ জানান, লিট ফেস্টের নয়টি আসরের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তিনি জানান এই ফেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের লেখক, প্রকাশকদের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।


তবে সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও লেখকদের অনেকেই এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। আয়োজনের প্রথম আসর থেকে প্রতিবারই ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহিত্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই লিট ফেস্টকে বিদেশি সাহিত্যিকদের প্রচার-প্রসারের প্লাটফর্ম হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলছেন, এতে বাংলা সাহিত্যের কোনো লাভ হচ্ছে না। সত্যিকারার্থে, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী আসলেই লিট ফেস্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও উপযোগী?


দশম আসর শেষ হয়ে গেল, লিট ফেস্ট বাংলাদেশে বিদেশি সাহিত্যের কতটা বিকাশ ঘটাতে পারল? বা অন্য দেশের সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কতটা জানল বা পড়ল? অন্যদিকে লিট ফেস্টকে অনেকেই রাজনৈতিক আয়োজন বা অর্থনৈতিক লাভালাভির বিষয় হিসেবে আখ্যা দিতে চান, এটা কতটা সঠিক?



ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজন নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিবার্তাকে বলেন, পৃথিবীর যত ভাষা আছে, যত সাহিত্য আছে, সমস্ত সাহিত্যের আন্তর্জাতিক যে ব্যাপ্তি রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা জরুরি। এটা সবচেয়ে বড় কথা। মোটকথা, যেকোনো সাহিত্য, সংস্কৃতিকে পৃথিবীর সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত না করে শুধুমাত্র দেশীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। তাকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক যে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা রয়েছে, তার সঙ্গে ‍যুক্ত করা প্রয়োজন। এটি লিট ফেস্টের ইতিবাচক দিক।


লিট ফেস্ট নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, লিট ফেস্টের নেতিবাচক দিক হলো- বাহিরের সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হতে গিয়ে কোনোমতে যেন আমরা আমাদের শিকড় থেকে বিচ্যুত না হই। এক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় ও আত্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে তারপর সতর্কভাবে বিশ্বের নানাপ্রান্তের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হতে হবে।


প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশে এখনও ইংরেজি সাহিত্যের পাঠক সংখ্যা খুব সীমিত থাকায় আদৌ লিট ফেস্ট গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবদান রাখল সাহিত্য অঙ্গনে?



গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বিবার্তাকে বলেন, ঢাকা লিট ফেস্ট হয়ে গেল। আমি মনে করি যে, সাহিত্যের জন্য এই রকম একটা উৎসবের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্ব অঙ্গনে পরিচিত করে দেওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের গল্প, আমাদের উপন্যাস, আমাদের প্রবন্ধ আরো বেশি করে অনূদিত হতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যাতে আমাদের সাহিত্য পড়া যায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের নিতে হবে। আর এই জায়গাটায় নিজেদের দেখতে গেলে বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্ব অঙ্গনে তুলে ধরার যেকোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়।


তিনি বলেন, এই লিট ফেস্টে আমরা যেটা খেয়াল করলাম এক ধরনের আভিজাত্য আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে করে যেটা হয়, যারা খুব সাধারণ লেখক তারা হয়তো এক ধরণের হীনমণ্যতায় ভুগতে পারেন অর্থাৎ আমি বোধহয় নাই এই চিন্তা তাদের আসতে পারে। আর এটি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কাজেই এটাকে কিভাবে আরও সার্বজনীন করা যায় এবং এখানে কিভাবে সাধারণ সাহিত্যিক, লেখক ও সাংবাদিকসহ সবাইকে যুক্ত করা যায়- এটা চিন্তা করা দরকার।


লিট ফেস্ট আয়োজন নিয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক অসীম সাহা বিবার্তাকে বলেন, আমি অনেক জায়গাতে বলেছি, ফেসবুকেও লিখেছি সেটা হলো লিট ফেস্ট উপভোগ করার অসুবিধা নেই। যেহেতু এই অনুষ্ঠানটা বাংলাদেশে হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন- বাংলাদেশের অস্তিত্ব কোথায়? এই অনুষ্ঠানকে লিট ফেস্ট বলা হচ্ছে। আর এখানে আন্তর্জাতিক কবি-লেখকরা আসবে সেখানে তো আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে কেনো লিখা হয়নি, ঢাকা সাহিত্য উৎসব অথবা বাংলাদেশ উৎসব। এটা তো নিচে লিখে দিতে পারতো বাংলায়। এখানে সর্বত্র দেখলাম ইংরেজির ছড়াছড়ি। বিদেশিরা যারা আসছে তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলা বিষয়ের আলোচনা আমি তেমন শুনিনি কিংবা পুরো লিট ফেস্ট ঘুরে আমি বাংলার অস্তিত্ব তেমন পাইনি। এটা খুবই আপত্তিকর। আমাদের বাংলাদেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করেছি। শহিদেরা জীবন দিয়েছেন এই দেশ ও দেশের ভাষার জন্য। অথচ সেই বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে যত বড় আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলা বা অন্য মেলা হোক না কেন সেটা একেবারে গ্রহণযোগ্য না।



তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় আমি বলতে চাই- গতকালকে লিট ফেস্ট নিয়ে আমার মনে হয়েছে এটা সাহিত্য মেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা অনেকটা পণ্য মেলা হয়ে গেছে। আর সাহিত্য মেলা যদি পণ্য মেলায় পরিণত হয়, তাহলে সেই মেলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।


ঢাকা লিট ফেস্ট নিয়ে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বিবার্তাকে আরো বলেন, এর আগে এই সাহিত্য আসরে গিয়েছিলাম। সেজন্য বলতে পারি এবারের আয়োজন অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে। ঢাকা লিট ফেস্টে সবসময় দেশের বাহিরে থেকে খুব নামকরা ও সুপরিচিত লেখকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই আয়োজন একটা উচ্চতার মাত্রা পায়। তাদের কথা শুনতে আমাদের লেখক ও সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন বিপুল সংখ্যায় যোগ দেয়। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, বুকার, পুলিৎজার ইত্যাদি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের অনেকেই আসেন। তারা বিভিন্ন সেশনে আলোচনায় অংশ নেন। তাদের কথা শুনতে বাংলা একাডেমির বড় অডিটোরিয়ামের পুরোটা ভরে যায়, মানুষ উপচে পড়ে। শ্রোতাদের অধিকাংশ হয়তো বোদ্ধা, এরা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষক, ছাত্র এবং সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত।



তিনি আরো বলেন, ঢাকা লিট ফেস্টে প্রথম দিককার এলিটিস্ট ভাবটা দূর হচ্ছে বলে মনে হয়। সেটাই ভালো। তবে বিদেশী সাহিত্য সংস্কৃতির পাশাপাশি আমাদের ধ্রুপদী সাহিত্য উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে আরো মনোযোগী হলে তা বিদেশ থেকে আগত স্বনামধন্য ব্যক্তিদেরও সমৃদ্ধ করবে। তারাও জানবেন যে, এই দেশেও আন্তর্জাতিক মানের লেখক রয়েছেন। তখন বাংলা সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বহুল পঠিত ও পরিচিত না হলেও এই সাহিত্যের প্রতি তারা আগ্রহী হবেন।


উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে আয়োজিত ঢাকা লিট ফেস্টের এবারের আসরে ১২৫টির বেশি সেশনে পাঁচটি মহাদেশের ৫০০ জনেরও বেশি বক্তা, শিল্পী ও চিন্তাবিদরা অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক, আব্দুলরাযাক গুরনাহসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরস্কার বিজয়ী বক্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও,এবারের উৎসবে এসেছিলেন সোমালিয়ার নুরুদ্দিন ফারাহ, শ্রীলঙ্কার শেহান কারুনাতিলাকা, ইংল্যান্ডের অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গবেষক সারাহ গিলবার্ট, বারবারা এপলারসহ নানা সাহিত্যিক-শিল্পী, বিশিষ্টজন। ছিলেনওপার বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী।


বাংলাদেশ বিশ্বসাহিত্যে নিজেদের জায়গা করে নেয়ার একটি প্রক্রিয়ায় মধ্যে আছে। এক্ষেত্রে শুধু লিট ফেস্ট যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন আয়োজকরাও। প্রত্যাশা সকলেরই লিট ফেস্ট হোক দেশি-বিদেশি সকল সাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনদের অংশগ্রহণের, খুলে যাক নতুনদের দুয়ার। বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্য সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চেও নিজ রূপে মহীয়ান হয়ে উঠুক বাংলা সাহিত্য।


বিবার্তা/সামিনা-সাইদুল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com