প্রশিক্ষণের গাড়ি সড়ক ও আবাসিক এলাকার নতুন আতঙ্ক
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ২২:১৮
প্রশিক্ষণের গাড়ি সড়ক ও আবাসিক এলাকার নতুন আতঙ্ক
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীতে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য গড়ে উঠেছে অনেক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল। যারা এসব স্কুল পরিচালনা করেন, তারাই কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না। এসব বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষকের লাইসেন্সই নেই। আবার নিজেদের জায়গা না থাকায় রাজধানীর অলি-গলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কেও চলছে এসব গাড়ি। এতে জনমনে বেড়েই চলছে আতঙ্ক।


ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নিয়ে বিআরটিএ বলছে, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের জন্য তারা যখন অনুমতি নেয় তখন সম্পূর্ণ তথ্যটা দিয়েই নেয়। পরবর্তীতে তারা ভায়োলেন্ট করেন।


অন্যদিকে পুলিশ বলছে, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের গাড়ি আবাসিক এলাকায় চালালে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


ড্রাইভিং স্কুল পরিচালনা করতে বিআরটিয়ের অনুমোদন পাওয়ার শর্তে উল্লেখ আছে- ড্রাইভিং শিখানো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা থাকতে হবে। প্রশিক্ষকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী ভালো মানের যানবাহন ও যথাযথ উপকরণ থাকতে হবে।



রাজধানীর বেশির ভাগ ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের অনুমতি নেই। আর অনুমতি থাকলেও প্রশিক্ষণের জন্য এসব স্কুলের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। ফলে, প্রশিক্ষকরা শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিতে আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে ব্যস্ত সড়কেও চলে আসছেন। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা, জনমনে তৈরি হচ্ছে শংকা।


সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল পরিচালনার জন্য একটি দোকান দিয়ে বসেছেন উত্তর বঙ্গ ড্রাইভিং স্কুল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল একজন শিক্ষার্থী ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হচ্ছেন। প্রশিক্ষণ স্কুলটির অনুমতি থাকলেও প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা নেই। তাই তারা মোহাম্মদপুরের আশপাশের সড়কগুলো ব্যবহার করছে।


উত্তর বঙ্গ ড্রাইভিং স্কুলে কর্তব্যরত মো. সোহেল মিয়া বিবার্তাকে বলেন, আমাদের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি অনুমতি নেওয়া আছে। আমাদের প্রশিক্ষক আছে, তিনি ছুটিতে ঢাকার বাইরে গেছে। আমরা গাড়ি চালানো শিখানোর জন্য আশপাশের সড়কগুলো ব্যবহার করি। বিআরটিএ আমাদের এই এলাকার নির্দিষ্ট এরিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা বিআরটিএ-এর নির্ধারিত এরিয়াতে সময় অনুযায়ী চালাই। তবে, স্কুল-প্রতিষ্ঠান যেসব এলাকায় আছে, সেসব রাস্তায় আমাদের যাওয়া নিষেধ। আমরা এসব জায়গায় যাইও না।


মোহাম্মদপুরের আশপাশে অনেক ড্রাইভিং স্কুল আছে। সলিমুল্লাহ রোডে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য বঙ্গ ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল নামের আরেকটি দোকান দেখা যায়। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রশিক্ষণ স্কুলের জন্য লাইসেন্স থাকলেও তার মেয়াদ নেই, নেই কোনো প্রশিক্ষক। তবে, লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন বলে জানান। নেই প্রশিক্ষণের জন্য কোনো জায়গা। এক্ষেত্রেও রাস্তাই একমাত্র ভরসা।


রাজধানীর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন অলি-গলির রাস্তায় ফেস্টুনে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেওয়া। ‘মাত্র ১৬ ঘণ্টয় ড্রাইভিং শিখুন’, ‘খুব যত্ন সহকারে ড্রাইভিং শিখানো হয়’।


বিজ্ঞাপণের ঠিকানা ধরে সামনে যেতেই দেখা গেল ধানমন্ডি আবাহনী খেলার মাঠের পাশেই মুন ড্রাইভিং স্কুল। ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষক মো. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, আমাদের শহরে কোনো জায়গা নেই, এমনকি খেলার মাঠও নেই। আমরা গাড়ি শিখানোর জায়গা কোথায় পাব। রাস্তায় শিখানো ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। আমরা খুব সকালে ও রাতে যখন রাস্তায় মানুষের চলাচল কম থাকে তখন প্রশিক্ষণ দেই।


শুধু মোহাম্মদপুর বা ধানমন্ডি নয় রাজধানীর শ্যামলী, জিগাতলা, কলাবাগান, হাতিরপুল, মতিঝিল, টিকাটুলী, গেণ্ডারিয়া, গ্রিনরোডসহ ফার্মগেটের মত ব্যস্ত এলাকায় ড্রাইভিং শিখানো হচ্ছে কোনো নিয়ম না মেনে। ব্যস্ত রাস্তায় প্রশিক্ষণের গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ছেন তারা। এতে দুশ্চিন্তায় থাকেন আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বাসিন্দারা।


রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা ও সড়কে ড্রাইভিং শিখাতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না থাকার পরও এসব প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে অনুমোদন। সবার চোখের সামনেই এসব গাড়ি চলছে যত্রতত্র।


রাজধানীর শংকরের স্থায়ী বাসিন্দা সাদিয়া সুলতানা বিবার্তাকে বলেন, প্রতিদিন সকালে আমি মেয়েকে নিয়ে ছায়ানটে যাই। এমনিতে ঢাকায় অদক্ষ চালকের জন্য সবসময় দুর্ঘটনা ঘটছে। আবার বিভিন্ন ড্রাইভিং স্কুলের প্রশিক্ষণের গাড়িগুলো স্কুলের আশপাশেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণার্থীরা মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। কেউই নিয়ম মানছেন না। এজন্য সবসময় মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় থাকি।


তিনি বলেন, এসব ড্রাইভিং স্কুলের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। তাই আবাসিক এলাকা থেকে ব্যস্ত রাস্তা সব জায়গায় এরা ড্রাইভিং শিখাচ্ছে। যা সাধারণ পথচারী, ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে। তাই এসব ড্রাইভিং প্রতিষ্ঠানকে রাজধানীর বাইরে অনুমতি দেওয়া দরকার।


এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ মোহাম্মদপুর ট্রাফিক জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইমরুল বিবার্তাকে বলেন, আমি আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের অনুমতি দেয়নি। এ নিয়ে আমাদের পুলিশের থেকে মতামত চাওয়া হয় বা নেওয়া হয় আর কি। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের বিষয়ে আমি এখানে যোগদান করার পর থেকে কোনো কাগজ পাইনি।



তিনি বলেন, আমরা যদি দেখি প্রশিক্ষণের গাড়ি সড়কে বা আবাসিক এলাকায় নিয়ম না মেনে চলছে। এসব আমাদের চোখে পড়লে বা সামনে পড়লে সড়ক ও পরিবহন আইনে যেটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমরা সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেই।


বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং স্কুলের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করা আছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, কোনো ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রতি হস্তক্ষেপের এখতিয়ার তো আমাদের নাই। তারা যাতে ব্যস্ত সড়কে না আসে, সড়কের নিয়ম মানছে কি না? আমরা এসব দেখি।


মো. ইমরুল বলেন, মোহাম্মদপুরে ড্রাইভিং স্কুল কতগুলা আছে তা আমার জানা নেই। আমি এখানে নতুন এসেছি। যারা ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের নিয়ম মানেন না, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ রমনা ট্রাফিক বিভাগের ডিসি মো. জয়নুল আবেদীনের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের জন্য নির্ধারিত জায়গা দেওয়া আছে। এটা বিআরটিএ থেকে বিভিন্ন জায়গায় অনুমোদন আছে, নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে।


এছাড়া ড্রাইভিং স্কুলের গাড়ি অন্য কোথাও চালালে বা সড়কের নিয়ম না মানলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিবো বলে জানান জয়নুল আবেদীন।


এ বিষয়ে বিআরটিএ (রোড সেফটি)-এর পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানীর সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য তারা যখন অনুমতি নেয়, সম্পূর্ণ তথ্যটা দিয়েই নেয়। পরবর্তীতে তারা ভায়োলেন্ট করেন। আমাদের কাছে যেকোনো বিষয়ে অনুমতি চাইলে ডকুমেন্টসহ দিতে হয়। আমাদের কাছে কেউ লিখিতভাবে অভিযোগ দিলে আমরা এ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।


শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী আরও বলেন, সড়ক বা আবাসিক এলাকায় আমাদের পাশাপাশি পুলিশ এসব বিষয় দেখে। এটা আসলে পুলিশের দেখার বিষয়। রাস্তাঘাটে উঠলে, নিয়ম না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটা আসলে পার্টিকুলার অভিযোগ না আসা পর্যন্ত আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমরা এসব বিষয় পরিকল্পনায় রেখে দ্রুত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিবো।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসএফ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com