আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো। এজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিপ লার্নিং ডিপফেক তৈরিতে সাহায্য করে তাই বেশিরভাগ সময় এই সম্পাদনাগুলো খালি চোখে বোঝা যায় না। ডিপফেক নিউজ বা ফেক ভিডিওকে সত্য বলেই ধরে নেন বেশিরভাগ মানুষ।
গত বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন এআই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের টুলস দিয়ে এগুলো তৈরি করা হচ্ছে যা উদ্বেগজনক। এরিমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার গত বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিবিসি গ্লোবাল টিমের পক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে ২০১৭ সালে কাজ করেছেন জ্যাকুই ওয়েকফিল্ড। তিনি মনে করেন, এ ফেক নিউজগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে সব দেশেই তৈরি হয়ে আসছে। মিথ্যা তথ্যগুলো ধরার জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো এআই শনাক্তকরণ টুল না থাকা। ফলে শাস্তির আওতায়ও আনা কঠিন অপরাধীকে।
কাউন্টার পাঞ্চকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যবহৃত ডিপফেকগুলোর অন্যতম একটি উদাহরণ হলো, ২০২২ সালের একটি ডিপফেক। যেখানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে বলে এমন একটি ভিডিও তৈরি করা হয়। যদিও এটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। তবে ভিডিওটি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে আছে।
আসন্ন নির্বাচনের আগে দেশেও এরকম কন্টেট তৈরি হচ্ছে। এমন একটি মিথ্যা ‘নিউজ ক্লিপে’ দেখা যায়, এআই ব্যবহার করে তৈরি করা উপস্থাপক যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করছেন।
আরেকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া ভাষায় সমালোচনা করছেন। কিন্তু যা সত্য নয় বলে জেনেছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। এ ভিডিও যে তৈরি হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে বাইডেন সরকারের দুরত্ব তৈরির জন্য তা স্পষ্ট।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেলআবিবভিত্তিক এআই ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ডি-আইডি ব্যবহার করে তৈরি একটি ডিপফেক ভিডিওতে দেখা যায়, বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান তার বয়স নিয়ে মিথ্যা বলছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট বলছে, এ ভুয়া ভিডিও তৈরি করা হয়েছে ওই নেতার সম্মানহানির জন্য।
এএফপির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি এমন কিছু নিবন্ধ লেখকদের আবিস্কার করা হয়েছে যাদের বড় অংশই ভুয়া, বাস্তবে এসব লেখকের অনেকের কোন অস্তিত্বই নেই। যদিও তাদের পরিচিতিতে তারা বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত পরিচয় দেন কিন্তু অনুসন্ধানে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বিবিসি গ্লোবাল টিমের জ্যাকুই ওয়েকফিল্ড বলেন, বিজ্ঞানসম্মত কনটেন্টের আড়ালে ইউটিউবে ভুল ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, ২০টিরও বেশি ভাষায় এরকম ভিডিও দেখতে পেয়েছে বিবিসি।
বাংলাদেশভিত্তিক গণমাধ্যম গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, এআই ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো তৈরি করা হচ্ছে ছবি ও ভিডিও সম্পাদনার সাধারণ প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে। তবে যখন এআই প্রযুক্তি দিয়ে বিপুল পরিমাণ মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হবে, সেটা কত বড় হুমকি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না।
ফেক নিউজ-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে রাজনৈতিক বিরোধ- সবক্ষেত্রেই ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি আরও মারাত্মক আকার ধারণের আশঙ্কা রয়েছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ফেক নিউজকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ নিজেদের বিরুদ্ধে গেলে সত্যি সংবাদকেও ফেক নিউজ হিসেবে চিত্রায়িত করে কর্তৃপক্ষ কাউকে জব্দ করার সুযোগ নিতে পারে।
এমওইউ’র সূত্র মতে, ডিপফেক শনাক্ত করার জন্য কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ এখনো রয়েছে। যেমন, এজ ক্লিপিং কিংবা নির্দিষ্ট কোণে মুখের বিকৃতি, ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে শুধু নকল ভিডিও তৈরি করতে পারে তা নয়। এটি মানুষের ভয়েস মডেলও তৈরি করতে পারে। এর মানে এই যে একজন রাজনীতিবিদের শব্দ বা কণ্ঠস্বর নকল করে কোনো আপত্তিকর বিবৃতি দেওয়ার জন্য এখন কোনো ছদ্মবেশীর প্রয়োজন হবে না। পরিবর্তে তাদের ভয়েস বা কণ্ঠস্বর নকল করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রশিক্ষিত করা সম্ভব।
সাইবার ক্রাইম বা ইন্টারনেটে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘অন্তর্জাল’-এর চিত্রনাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আশা জাহিদ বলেন, এখন অনলাইনের নানা সফটওয়্যার ও প্ল্যাটফরম থেকে সহজেই ডিপ ফেক ভিডিও বানানো যায়। এ জন্য বিশেষ কোনো কোডিং শেখার প্রয়োজন হচ্ছে না। অনেক মোবাইল অ্যাপও আছে, যার মাধ্যমে ছবি থেকে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সিনেমার ক্লিপকে বিশেষভাবে সম্পাদনা করে ভিডিও বানানো যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্পাইডারম্যান বা আয়রনম্যান সিনেমায় নায়কের বদলে অন্য কারো চেহারা বসিয়ে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে।
বিবার্তা/লিমন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]