ইতিহাস ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেতে ত্রিপুরা ভ্রমণ
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৮
ইতিহাস ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেতে ত্রিপুরা ভ্রমণ
পর্যটন ডেস্ক
'
প্রিন্ট অ-অ+

ত্রিপুরা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। এই রাজ্যের আয়তন ১০,৪৯১.৬৯ বর্গকিলোমিটার, এবং এটি ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য । ত্রিপুরা উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বাংলাদেশ কর্তৃক বেষ্টিত; রাজ্যের পূর্বভাগে ভারতের অপর দুই রাজ্য আসাম ও মিজোরাম অবস্থিত। 


ত্রিপুরা নামটির উদ্ভব হয় ত্রিপুরার পৌরাণিক মহারাজা ত্রিপুরের নামানুসারে। ত্রিপুর ছিলেন যযাতির বংশধর দ্রুহ্যের ৩৯ তম উত্তরপুরুষ। অপর এক ব্যাখ্যা অনুসারে ত্রিপুরা নামটির উৎস হল হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত দশমহাবিদ্যার একতম ত্রিপুরাসুন্দরী। তাছাড়া ত্রিপুরা শব্দটির উৎপত্তি রাজ্যের আদিবাসীদের অন্যতম ভাষা ককবরক থেকেও এসেছ বলে অনেকে মনে করেন। ককবরক ভাষায় 'তৈ' হল জল। 'প্রা' হল নিকটে। জলের নিকটবর্তী স্থান তৈ-প্রা থেকে ধীরে ধীরে তেপ্রা, তিপ্রা এবং শেষে বাঙালি উচ্চারণে ত্রিপুরা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।


বিভিন্ন সংস্কৃতি, উপজাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবাসস্থল ত্রিপুরা। চাষাবাদ, চা বাগান, টয় ট্রেনসহ আরও অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত।


মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য পরিচিত রাজ্যটি তার উপজাতীয় সংস্কৃতি ও খাবারের জন্যও জনপ্রিয়। ত্রিপুরায় দেখার মতো অনেক জায়গা আছে।


ত্রিপুরায় বেড়াতে গেলে আপনি কোথায় কোথায় যাবেন, কী কী দেখবেন আর কী ভাবে ঘুরবেন তা আগে থেকেই জেনে নেওয়া ভালো। তাহলে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি ছাড়াই ছুটি কাটাতে পারবেন।


নীর মহল


নামকরণ থেকেই বোঝা যায় জলের উপর দাঁড়িয়ে আছে যে মহল, উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র জলমহল হল এটি। আগরতলা থেকে ৫১ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত জনপদটির নাম মেলাঘর। মেলাঘরের দুই কিলোমিটার দূরেই অবস্থান নীরমহলের। বিশাল রুদ্রসাগর সরোবরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব এই রাজপ্রাসাদ। মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শুরু করান এই সুদৃশ্য প্রাসাদটির। প্রাসাদের স্থাপত্যে মুঘল শৈলীর প্রভাব যথেষ্টই বোঝা যায়। নির্মাণকার্য শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর।


১২২ মিটার লম্বা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা রঙের প্রাসাদে রয়েছে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ, যাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান। প্রাসাদের গম্বুজ আকৃতির মিনারগুলি, বিরাট ‘দরবার কক্ষ’, রাজা-রানির বিশ্রামকক্ষ, সুউচ্চ নজরমিনার সবই চমৎকৃত করবে। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে জলের মধ্যে থাকা নীরমহলকে দেখে রাজস্থানের উদয়পুরের লেক-প্যালেস ‘জগনিবাস’-এর (পিছোলা লেকের উপর অবস্থিত) কথা মনে পড়বে। রুদ্রসাগর লেকের জলেও পড়ে নীরমহলের প্রতিবিম্ব। ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগর সরোবর বিভিন্ন ধরনের পাখির (বিশেষত পরিযায়ী) জলকেলির এক নিরাপদ ঠাঁই। নীরমহলের প্রশস্ত ছাদ থেকেও রুদ্রসাগরের এক দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।


রুদ্রসাগরের পাড় থেকে (সাগরমহল ট্যুরিস্ট লজের প্রান্তে) নিয়মিত মোটরবোট চলাচল করে নীরমহল পর্যন্ত, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি। ভাড়া মাথাপিছু ১০ টাকা। সপ্তাহের প্রতি দিনই খোলা থাকে নীরমহল। জুলাই মাসে প্রতি বছর এক নৌকা প্রতিযোগিতার আসরও বসে রুদ্রসাগরের জলে। নীরমহল প্রাসাদে ঢোকার প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ১০ টাকা। স্টিল ক্যামেরার চার্জ ২০ টাকা। ভিডিও ক্যামেরার চার্জ ৪০ টাকা।


উদয়পুর


দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার সদর শহর হল উদয়পুর। আগরতলা থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। মধ্যযুগে ত্রিপুরার রাজাদের রাজধানীও ছিল এই উদয়পুর। সে সময় রাঙামাটি নামেই পরিচিত ছিল এই জায়গাটি। রাজস্থানের উদয়পুরের মতোই ত্রিপুরার উদয়পুরকেও ‘লেক সিটি’ বলাই যায় নির্দ্বিধায়। সুখসাগর, অমরসাগর, জগন্নাথ দিঘি, মহাদেব দিঘি ইত্যাদি সুদৃশ্য জলাশয় সৌন্দর্য বাড়িয়েছে উদয়পুরের। আবার মন্দির-নগরীও বলা যেতে পারে উদয়পুরকে। ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী, গুণবতী মন্দিররাজি, বিষ্ণু মন্দির, মহাদেব মন্দির, দুর্গামন্দির, জগন্নাথ মন্দিরের মতো প্রাচীন ও বিখ্যাত মন্দিরগুলির অবস্থান এখানেই। আগরতলা থেকে উদয়পুর যাওয়ার পথেই পড়বে তেপানিয়া ইকো-পার্ক (এখান থেকে উদয়পুরের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার)। সুন্দর এই পার্কটিতে ঝুলন্ত সেতু, অর্কিড হাউস, গাছবাড়ি, ক্যাকটাস হাউস প্রভৃতি রয়েছে। ঘন জঙ্গলে ঘেরা সুদৃশ্য পার্কটি দেখেও চলে যেতে পারেন উদয়পুর। নীরমহল থেকে উদয়পুরের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার।


পিলাক


দক্ষিণ ত্রিপুরার পিলাক এক ঐতিহাসিক স্থান। বৌদ্ধ ও হিন্দু স্থাপত্যের অনেক বিস্ময়কর নির্দশন পাওয়া গিয়েছে পিলাক ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে। আগরতলা থেকে দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার। প্রাচীন মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষগুলিও যথেষ্ট নজরকাড়া। এখান থেকেই পাওয়া গিয়েছিল নবম শতাব্দীর ‘অবলোকিতেশ্বর’ ও দ্বাদশ শতাব্দীর ‘নরসিংহ’-র বিশাল মূর্তিগুলি। এই মূর্তিগুলি বর্তমানে আগরতলার সরকারি মিউজিয়ামে রাখা আছে। এখনও পিলাকে রাখা গণেশ, দুর্গা ও সূর্যমূর্তি (১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট) পর্যটকের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে। পিলাকের কাছে ঋষ্যমুখ থেকেও পাওয়া যায় বুদ্ধের দু’টি ব্রোঞ্জের মূর্তি। ঐতিহাসিক ভাবে প্রথমে বৌদ্ধ রাজারা ও পরবর্তীকালে হিন্দু রাজাদের শাসনকালে নমুনা পাওয়া যায় এই জায়গায়। খুব কাছেই অবস্থিত বাংলাদেশের ময়নামতী ও পাহাড়পুরের সঙ্গেও এই জায়গার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বিশেষ ভাবেই চোখে পড়ে। উদয়পুর থেকে পিলাকের দূরত্ব ৬২ কিলোমিটার।


মহামুনি প্যাগোডা


দক্ষিণ ত্রিপুরার আর একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হল মহামুনি প্যাগোডা। আগরতলা থেকে দূরত্ব ১৩৪ কিলোমিটার। উদয়পুর থেকে দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার আর পিলাক থেকে দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। মহামুনি প্যাগোডার অবস্থান হল মনুবংকুল নামক স্থানে। স্বর্নাভ প্যাগোডাটি শুধু যে সুদৃশ্য তাই নয়, সারা বছরই দেশ ও বিদেশের (মায়ানমার, জাপান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ) প্রচুর বৌদ্ধ পুণ্যার্থীও আসেন এই বৌদ্ধতীর্থে। এখান থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরেই সাবরুম। এখানেই বাংলাদেশ সীমান্ত ফেনী নদীর ওপারে। দেখে নিতে পারেন সেটিও একযাত্রায়।


উনাকোটি


উনাকোটি হলো ত্রিপুরা রাজ্যের একটি জেলা। এটি তার কালজয়ী ধ্বংসাবশেষের জন্য বিখ্যাত। এখানকার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হলো খোদাই করা শিলা।


যা অত্যন্ত দক্ষ শিল্পীদের দ্বারা খোদাই করা হয়েছিল। উনাকোটি তার পৌরাণিক কাহিনির জন্যও অত্যন্ত বিখ্যাত। আপনি গাড়ি বা ট্রেনে চড়ে এই জায়গায় পৌঁছাতে পারেন।


বড়মুড়া ইকো পার্ক


আপনি যদি একজন শান্তিপ্রিয় ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ হন, তাহলে স্থানটি হতে পারে আপনার জন্য একটি আদর্শ গন্তব্য। জঙ্গলে ঘেরা ও বড়মুড়া পাহাড়ি শ্রেণির মধ্যেই অবস্থিত এই পার্ক।


সেখানে ছোট-বড় অনেক ব্রিজ ও কুঁড়ে ঘর আছে। আর প্রতিটি কুঁড়ে ঘর ও সেতুর নকশা অন্যটির থেকে আলাদা। সপ্তাহজুড়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই ইকো পার্ক।


ডম্বুর লেক


ডম্বুর লেকের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখলে আপনি মুগ্ধ হবেনই। এই হ্রদে ৪৮টি দ্বীপ, পরিযায়ী পাখি ও জলজ জীবন আছে।


আগরতলা ডম্বুর হ্রদ থেকে মাত্র ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ও ত্রিপুরার অন্যতম সেরা পর্যটন স্থান। আপনি এখানে বোটিং করতেও যেতে পারেন।


জাম্পুই পাহাড়


জাম্পুই পাহাড় উত্তর ত্রিপুরা জেলায় অবস্থিত ও মিজো পাহাড়ের একটি অংশ। স্থানটি তার প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য পরিচিত। বেশিরভাগ হোটেল থেকেই আপনি পাহাড়ের সেরা মনোরম দৃশ্যগুলির সাক্ষী থাকতে পারবেন।


কমলা সাগর পিকনিক স্পট


এখানে একটি কৃত্রিম হ্রদ আছে ও সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর। লোকেরা সাধারণত এখানে পিকনিকের পরিকল্পনা করে। অক্টোবর মাসে এখানে একটি দারুণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।


বিস্তারিত তথ্য ও সরকারি ট্যুরিস্ট লজের বুকিং-এর জন্য যোগাযোগ:


অতুল দেববর্মা, অধিকর্তা, ত্রিপুরা ট্যুরিজম, কলকাতা শাখা (ত্রিপুরা ভবন, ১ প্রিটোরিয়া স্ট্রিট, কলকাতা-৭১)


ফোন: ৯৩৩১২-৩১৪৫৯, ৭৯৮০১-০৩০৮১


যাত্রাপথ: আগরতলা থেকে গাড়িভাড়া করেই ঘুরে নিতে হবে দক্ষিণ ত্রিপুরার এই সব জায়গা। গাড়িভাড়া পড়বে ছোট গাড়ির ক্ষেত্রে (ইন্ডিকা, ওয়াগন আর, ইকো ইত্যাদি) ২২০০-২৫০০ টাকা (প্রতি দিন), আর বড় গাড়ির ক্ষেত্রে (স্করপিও, বোলেরো, জাইলো ইত্যাদি) ৩০০০-৩৫০০ টাকা প্রতি দিন।


যোগাযোগ: সঞ্জীব আচার্য, নীলজ্যোতি ট্রাভেলস, আগরতলা


ফোন: ০৯৪৩৬৪-৫৬০৮৮, ০৯৮৫৬০-৯৩০০৭


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com